শিশুর জ্বর সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে এবং কয়েক দিনের মধ্যে কমে যায়। তবে অনেক সময় দেখা যায়, জ্বর সহজে কমছে না বা বারবার ফিরে আসছে। এটি অভিভাবকদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। শিশুর জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হলে সেটি কোনো গুরুতর সংক্রমণের ইঙ্গিত দিতে পারে, তাই দ্রুত সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এই ব্লগে আমরা জানবো শিশুর জ্বর না কমলে কী করণীয়, কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার, এবং কীভাবে শিশুর যত্ন নিতে হবে।
শিশুর জ্বর কত হলে চিন্তার কারণ?
সাধারণত শিশুর শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৭°F – ৯৯°F (৩৬.১°C – ৩৭.২°C) এর মধ্যে থাকে। তবে জ্বরের মাত্রা নির্ভর করে মাপার পদ্ধতির ওপর—
- মলদ্বার (Rectal) বা কানের থার্মোমিটার অনুযায়ী: ১০০.৪°F (৩৮°C) বা তার বেশি
- মুখ (Oral) অনুযায়ী: ৯৯.৫°F (৩৭.৫°C) বা তার বেশি
- বগল (Armpit) অনুযায়ী: ৯৯°F (৩৭.২°C) বা তার বেশি
⚠️ কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
✅ জ্বর ১০২°F (৩৮.৯°C) বা তার বেশি হলে
✅ জ্বর ৩ দিনের বেশি স্থায়ী হলে
✅ শিশু খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিলে বা প্রচণ্ড দুর্বল হলে
✅ শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি বা তীব্র ঘাম দেখা দিলে
✅ জ্বরের সাথে বমি, ডায়রিয়া, বা শরীরে র্যাশ দেখা দিলে
✅ শিশুর জ্বর বারবার ফিরে আসলে
শিশুর জ্বর না কমার কারণ
✅ ভাইরাস সংক্রমণ (Viral Infection):
- সাধারণ ফ্লু, ঠান্ডা, বা ভাইরাল জ্বরের কারণে হতে পারে।
- সাধারণত ৩-৫ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়, তবে কিছু ভাইরাসজনিত সংক্রমণ (যেমন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া) দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
✅ ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ (Bacterial Infection):
- নিউমোনিয়া, টনসিলাইটিস, ইউরিন ইনফেকশন (UTI), টাইফয়েড ইত্যাদি কারণে জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
- এন্টিবায়োটিক চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
✅ ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়া:
- উচ্চ জ্বর, শরীরে ব্যথা, র্যাশ থাকলে ডেঙ্গুর লক্ষণ হতে পারে।
- রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
✅ ইনফ্লুয়েঞ্জা (Flu):
- সাধারণ ভাইরাসের চেয়ে বেশি দিন স্থায়ী হতে পারে এবং শিশু খুব দুর্বল হয়ে পড়ে।
✅ ইনফেকশন বা প্রদাহ:
- শিশুর শরীরে কোথাও ইনফেকশন (যেমন কানে ইনফেকশন, গলায় ইনফেকশন) হলে জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
✅ অন্য কোনো গুরুতর অসুস্থতা:
- যদি শিশুর জ্বর দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় এবং ওজন কমতে থাকে, তাহলে এটি টিউবারকুলোসিস (TB) বা অন্য কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগের লক্ষণ হতে পারে।
শিশুর জ্বর না কমলে করণীয়
১. শিশুর শরীরের তাপমাত্রা নিয়মিত মাপুন
- ডিজিটাল থার্মোমিটার ব্যবহার করে ৬-৮ ঘণ্টা পরপর জ্বর পরিমাপ করুন।
- শিশুর জ্বর যদি ১০২°F (৩৮.৯°C) বা তার বেশি হয়, তবে দ্রুত ব্যবস্থা নিন।
২. শিশুকে বিশ্রাম দিন
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করুন।
- অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা পরিবেশ এড়িয়ে চলুন।
৩. তরল খাবার বেশি দিন
- মায়ের দুধ (যদি শিশু ৬ মাসের কম বয়সী হয়)।
- ডাবের পানি, লেবুর শরবত, স্যুপ, ফলের রস।
- পানিশূন্যতা রোধ করতে ওআরএস দিন (বিশেষ করে যদি শিশুর ডায়রিয়া থাকে)।
৪. শরীর মুছে দিন (Sponging)
- কুসুম গরম পানি দিয়ে শিশুর শরীর মুছে দিন।
- কখনোই বরফ বা অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি ব্যবহার করবেন না।
৫. ওষুধ দিন (চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী)
- প্যারাসিটামল (Paracetamol): শিশুর ওজন অনুযায়ী ডোজ দিন।
- আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen): ৬ মাসের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য ব্যবহার করা যায়।
- অ্যাসপিরিন এড়িয়ে চলুন: এটি শিশুদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৬. সহজপাচ্য খাবার দিন
- তরল ও নরম খাবার দিন, যেমন—খিচুড়ি, স্যুপ, ডাল-ভাত।
- শিশুর ক্ষুধা কমে গেলে জোর করে খাওয়ানোর দরকার নেই।
জ্বর না কমলে কী করবেন না?
❌ শিশুকে অতিরিক্ত গরম কাপড় পরাবেন না।
❌ বরফ বা অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি ব্যবহার করবেন না।
❌ এন্টিবায়োটিক নিজে থেকে দেবেন না, চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
❌ শিশুকে জোর করে খাবার খাওয়াবেন না।
জ্বর প্রতিরোধের উপায়
✅ শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন।
✅ সংক্রমণ এড়াতে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
✅ শিশুর টিকা সময়মতো দিন।
✅ শিশুকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার ও বিশুদ্ধ পানি দিন।
উপসংহার
শিশুর জ্বর সাধারণত স্বল্পমেয়াদী হয়, তবে যদি এটি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা জ্বর না কমে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। শিশুর যত্ন নেওয়ার সময় সচেতনতা ও ধৈর্য্য জরুরি।
আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্টে জানান!