যক্ষ্মা (Tuberculosis – TB) হল একটি সংক্রামক ব্যাধি, যা মূলত মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস (Mycobacterium tuberculosis) নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। এটি প্রধানত ফুসফুসকে আক্রান্ত করে, তবে শরীরের অন্যান্য অংশ যেমন হাড়, কিডনি, মস্তিষ্ক, ও লিভারেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে— যক্ষ্মা কি ছোঁয়াচে রোগ? এই প্রশ্নের উত্তর হল হ্যাঁ, যক্ষ্মা একটি ছোঁয়াচে রোগ, তবে এটি কেবল তখনই সংক্রামক হয় যখন তা সক্রিয় অবস্থায় থাকে। আসুন বিস্তারিতভাবে জানি যক্ষ্মার সংক্রমণ, লক্ষণ ও প্রতিকার।
যক্ষ্মা কিভাবে ছড়ায়?
যক্ষ্মা প্রধানত বাতাসের মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে ছড়ায়।
- হাঁচি বা কাশি: যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে বাতাসে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে।
- কথা বলা: সংক্রমিত ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে কথা বললে জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে যেতে পারে।
- নিঃশ্বাসের মাধ্যমে: আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকলে এবং দীর্ঘ সময় তার সংস্পর্শে থাকলে যক্ষ্মার জীবাণু অন্য ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
- ব্যবহৃত জিনিসপত্র: যদিও যক্ষ্মা সাধারণত সরাসরি স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায় না, তবে সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড়, থালা-বাসন, বা তোয়ালে থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকতে পারে।
তবে যক্ষ্মা হাত মেলানো, খাবার ভাগাভাগি করা বা চুম্বনের মাধ্যমে ছড়ায় না।
যক্ষ্মার লক্ষণ
যক্ষ্মার লক্ষণ ধীরে ধীরে দেখা দেয় এবং কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় না।
১. সাধারণ লক্ষণ:
- দীর্ঘস্থায়ী কাশি (৩ সপ্তাহ বা তার বেশি)
- রাতের বেলা ঘাম হওয়া
- ওজন হ্রাস
- ক্ষুধামন্দা
- দুর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভব করা
- বুক ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট
২. গুরুতর লক্ষণ:
- কাশির সঙ্গে রক্ত আসা
- বুকের ব্যথা
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
- অত্যধিক জ্বর (সন্ধ্যার দিকে বাড়ে)
যদি এই লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনোটি দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
যক্ষ্মা কতটা ছোঁয়াচে?
যক্ষ্মা সক্রিয় অবস্থায় থাকলে এটি সংক্রামক হতে পারে। তবে ল্যাটেন্ট টিবি (Latent TB) অর্থাৎ সুপ্ত অবস্থায় থাকলে এটি সংক্রামক নয়।
- সক্রিয় যক্ষ্মা: এই অবস্থায় জীবাণু সক্রিয় থাকে এবং অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে।
- সুপ্ত যক্ষ্মা: জীবাণু শরীরে থাকলেও এটি সক্রিয় নয়, ফলে এটি ছড়ায় না। তবে ভবিষ্যতে এটি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
যক্ষ্মা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী সংস্পর্শে আসলে ছড়ায়। তাই এটি ফ্লু বা সাধারণ ঠান্ডার মতো সহজে সংক্রমিত হয় না।
যক্ষ্মা প্রতিরোধের উপায়
১. যক্ষ্মার টিকা (BCG টিকা):
- নবজাতকদের বিসিজি (BCG) টিকা দেওয়া হয়, যা যক্ষ্মা প্রতিরোধে কার্যকর।
- যেসব এলাকায় যক্ষ্মার প্রকোপ বেশি, সেখানে শিশুদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক।
২. স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা:
- আক্রান্ত ব্যক্তিকে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে, যাতে সংক্রমণ কমে যায়।
- কাশি বা হাঁচির সময় মুখ ঢেকে রাখা উচিত।
- আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত সামগ্রী আলাদা রাখা জরুরি।
- ঘর পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা উচিত, কারণ সূর্যের আলো ব্যাকটেরিয়াকে নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করে।
৩. সংক্রমিত ব্যক্তির চিকিৎসা:
যক্ষ্মার চিকিৎসা সময়মতো না করালে এটি গুরুতর হয়ে যেতে পারে। DOTS (Directly Observed Treatment, Short-course) প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। চিকিৎসার কোর্স ৬ মাস থেকে ৯ মাস পর্যন্ত চলতে পারে, যা সম্পূর্ণ করতে হবে।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?
যদি –
✅ তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে কাশি থাকে
✅ কাশির সঙ্গে রক্ত আসে
✅ রাতের বেলা অতিরিক্ত ঘাম হয়
✅ ওজন দ্রুত কমে যায়
✅ শ্বাস নিতে সমস্যা হয়
তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
উপসংহার
যক্ষ্মা একটি সংক্রামক ব্যাধি হলেও এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিলে এটি সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব। সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণের আশঙ্কা কমে যায়। তাই কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।