প্রসাবের সাথে রক্ত বের হওয়ার কারণ: হেমেচুরিয়া এবং এর প্রতিকার

প্রসাবের সাথে রক্ত বের হওয়াকে চিকিৎসা পরিভাষায় “হেমেচুরিয়া” বলা হয়। এটি একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি বিভিন্ন গুরুতর রোগের পূর্বাভাস হতে পারে। হেমেচুরিয়া দুই ধরনের হতে পারে:

  • গ্রস হেমেচুরিয়া: যখন প্রসাবের সাথে চোখে দেখা যায় এমনভাবে রক্ত বের হয়।
  • মাইক্রোস্কোপিক হেমেচুরিয়া: যেখানে রক্তের পরিমাণ খুবই কম এবং শুধুমাত্র মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে ধরা যায়।

প্রসাবের সাথে রক্ত বের হওয়ার কারণসমূহ

১. মূত্রনালীতে সংক্রমণ (UTI)

মূত্রনালীতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে প্রসাবের সাথে রক্ত আসতে পারে। UTI-এর প্রধান লক্ষণগুলির মধ্যে জ্বালাপোড়া, ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজন, এবং ব্যথা উল্লেখযোগ্য।

raju akon youtube channel subscribtion

২. কিডনি বা মূত্রথলিতে পাথর

কিডনি বা মূত্রথলিতে পাথর জমলে প্রসাবের সাথে রক্ত বের হতে পারে। পাথর মূত্রনালীতে যন্ত্রণা সৃষ্টি করে এবং রক্তক্ষরণ ঘটায়, যা প্রসাবের সাথে মিশে যায়। কিডনির পাথর হলে তীব্র পিঠে বা পেটের ব্যথা হতে পারে।

৩. মূত্রথলির সংক্রমণ (Cystitis)

মূত্রথলির প্রদাহ বা সংক্রমণও প্রসাবে রক্তের কারণ হতে পারে। এটি সাধারণত ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের কারণে ঘটে।

৪. কিডনি রোগ

কিডনির প্রদাহজনিত রোগ যেমন গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিসে আক্রান্ত হলে প্রসাবে রক্ত দেখা যায়। এটি কিডনির ফিল্টারিং সিস্টেমে প্রদাহ সৃষ্টি করে, ফলে রক্ত প্রসাবে মিশে যায়।

৫. প্রস্টেটের বৃদ্ধি (Benign Prostatic Hyperplasia)

পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি হলে মূত্র প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, ফলে প্রসাবে রক্ত দেখা দেয়। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে প্রস্টেটের এই সমস্যা দেখা যায়।

৬. মূত্রাশয় বা কিডনি ক্যান্সার

মূত্রাশয় বা কিডনিতে ক্যান্সার হলে রক্তক্ষরণ হতে পারে, যা প্রসাবে রক্তের উপস্থিতি ঘটায়। এটি সাধারণত ক্যান্সারের প্রথমদিকের লক্ষণ হতে পারে।

৭. গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস

এই রোগে কিডনির ছোট রক্তনালীতে প্রদাহ হয়, ফলে প্রসাবে রক্ত দেখা দিতে পারে।

৮. চোট বা আঘাত

কোনো ধরনের আঘাত বা দুর্ঘটনায় কিডনি বা মূত্রথলি ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রসাবের সাথে রক্ত বের হতে পারে।

৯. ওষুধের প্রভাব

কিছু ওষুধ যেমন রক্ত পাতলা করার ওষুধ (এন্টিকোয়াগুলান্ট) এবং ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ প্রসাবে রক্তের উপস্থিতি ঘটাতে পারে।

১০. ইনফেকশন

বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের ফলে কিডনি এবং মূত্রথলিতে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে, যা প্রসাবের সাথে রক্ত আসার কারণ হতে পারে।

প্রসাবের সাথে রক্ত বের হলে করণীয়

১. চিকিৎসকের পরামর্শ

প্রথমেই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ প্রসাবের সাথে রক্ত বের হওয়া অনেক রোগের লক্ষণ হতে পারে। চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক কারণ নির্ণয় করবেন।

২. ইউরিন টেস্ট

প্রসাবে রক্তের উপস্থিতি এবং ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য উপাদানের জন্য ইউরিন টেস্ট করানো হয়।

৩. ইউএসজি বা সিটি স্ক্যান

কিডনি বা মূত্রথলিতে পাথর বা অন্যান্য সমস্যার জন্য আল্ট্রাসাউন্ড (USG) বা সিটি স্ক্যান করা যেতে পারে।

৪. ওষুধ

সংক্রমণ বা প্রদাহ থাকলে চিকিৎসক এন্টিবায়োটিক বা অন্যান্য ওষুধ দিতে পারেন। এছাড়া প্রস্টেটের সমস্যা থাকলে প্রস্টেটের আকার কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হতে পারে।

৫. সঠিক পানি পান করা

পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করলে মূত্রনালী পরিষ্কার থাকে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়। এটি কিডনির কার্যকারিতা বাড়ায় এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীরের টক্সিন দূর হয়।

সতর্কতা ও প্রতিকার

  • সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা: প্রসাবের সময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।
  • নিয়মিত চেকআপ: কিডনি বা মূত্রনালীর সমস্যায় ভুগলে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত।
  • উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার ও প্রসেসড খাবার এড়ানো: অতিরিক্ত প্রোটিন এবং প্রসেসড খাবার কিডনির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

উপসংহার

প্রসাবের সাথে রক্ত বের হওয়া সাধারণ কোনো সমস্যা নয় এবং তা অবহেলা করা উচিত নয়। এই অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন, কারণ এটি বিভিন্ন গুরুতর রোগের লক্ষণ হতে পারে। সঠিক সময়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসা করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top