হেপাটাইটিস সি হলো লিভারের একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, যা হেপাটাইটিস সি ভাইরাস (HCV) দ্বারা ঘটে। এই ভাইরাসটি লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং যদি এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে সিরোসিস, লিভার ফেইলিউর বা লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস সি দীর্ঘদিন ধরে লক্ষণহীন থাকতে পারে, তাই প্রায়শই এটি ধরা পড়তে দেরি হয়।
হেপাটাইটিস সি কেন হয়?
হেপাটাইটিস সি ভাইরাস মূলত রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়। নিচে হেপাটাইটিস সি সংক্রমণের প্রধান কারণগুলো তুলে ধরা হলো:
১. সংক্রমিত রক্তের সংস্পর্শে আসা
যখন একজন সুস্থ ব্যক্তি সংক্রমিত রক্তের সংস্পর্শে আসে, তখন তার মধ্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি ঘটে:
- রক্তসঞ্চালন: পুরনো সময়ে, যখন রক্ত পরীক্ষার আধুনিক পদ্ধতি ছিল না, তখন এই ভাইরাস রক্তসঞ্চালনের মাধ্যমে সহজেই ছড়াতো। বর্তমানে, উন্নত দেশগুলোতে রক্ত সঞ্চালনের আগে পরীক্ষা করা হয়।
- অশুদ্ধ সূঁচ ব্যবহার: ড্রাগ সেবনকারীদের মধ্যে সাধারণ একটি সংক্রমণ মাধ্যম হলো সংক্রমিত সূঁচের ব্যবহার। একই সূঁচ দিয়ে যদি একাধিক ব্যক্তি ড্রাগ ইনজেক্ট করেন, তবে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটে।
- অশুদ্ধ ট্যাটু ও পিয়ার্সিং: যদি ট্যাটু বা পিয়ার্সিং করার সময় অপরিষ্কার সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, তবে হেপাটাইটিস সি সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
২. মা থেকে শিশুর মধ্যে সংক্রমণ
যদি কোনো মা গর্ভাবস্থায় হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তবে তার সন্তানও জন্মের সময় এই ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে। যদিও এই ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম, তবুও কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়।
৩. যৌন সংক্রমণ
যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম। তবে যদি সঙ্গীর যৌনাঙ্গে ক্ষত থাকে বা সংক্রমিত রক্তের সংস্পর্শ ঘটে, তবে ঝুঁকি বাড়ে।
৪. স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ
হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যারা কাজ করেন, তারা যদি সংক্রমিত রক্তের সংস্পর্শে আসেন, তবে তারা সংক্রমিত হতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, রোগীর ইনজেকশন দেওয়ার সময় সূঁচের আচমকা আঘাত লাগলে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ছড়াতে পারে।
হেপাটাইটিস সি-এর লক্ষণ
হেপাটাইটিস সি-এর সংক্রমণ বেশিরভাগ সময় লক্ষণহীন হতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে, সংক্রমণের প্রাথমিক বা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
- অবসাদ: অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা।
- জ্বর: হালকা জ্বর দেখা দিতে পারে।
- পেটে ব্যথা: বিশেষ করে ডান পাশে পেটের উপরের অংশে ব্যথা হতে পারে।
- বমি বমি ভাব বা বমি: খাবারে অরুচি বা বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে।
- চোখ ও ত্বক হলুদ হওয়া (জন্ডিস): লিভারের সংক্রমণ বেশি হলে ত্বক ও চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যায়।
- গাঢ় প্রস্রাব: লিভার ঠিকমতো কাজ না করলে প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হতে পারে।
- প্রস্রাবে ফেনা বা ফোসকা: দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ থাকলে প্রস্রাবে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
হেপাটাইটিস সি প্রতিরোধ ও প্রতিকার
হেপাটাইটিস সি প্রতিরোধের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
১. পরিষ্কার সরঞ্জামের ব্যবহার
যারা ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ গ্রহণ করেন, তারা অবশ্যই একবার ব্যবহারযোগ্য পরিষ্কার সূঁচ ব্যবহার করবেন। তেমনি যারা ট্যাটু বা পিয়ার্সিং করান, তারা পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ সরঞ্জাম ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
২. রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত
যে কোনো রক্ত সঞ্চালনের আগে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমণমুক্ত রক্ত নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
৩. ব্যক্তিগত সরঞ্জাম ব্যবহার
ক্ষুর, দাঁতের ব্রাশ, বা নখ কাটার যন্ত্রের মতো ব্যক্তিগত সামগ্রী কখনও ভাগাভাগি করা উচিত নয়। এগুলো সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. যৌন সুরক্ষা
যৌন সম্পর্কের সময় কনডমের ব্যবহার হেপাটাইটিস সি সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।
৫. চিকিৎসা গ্রহণ
বর্তমানে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ পাওয়া যায়, যা ভাইরাসকে দমিয়ে রাখে এবং লিভারকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহার
হেপাটাইটিস সি একটি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ, যা রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে অবশ্যই পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা এবং সংক্রমিত রক্তের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা জরুরি। চিকিৎসার মাধ্যমে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যদি আপনার মধ্যে উপরের লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।