বুকের হাড় বা বুকের মাঝের অংশে ব্যথা হওয়া একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এর পিছনে থাকা কারণগুলি বুঝে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বুকের হাড়ের ব্যথা অনেক সময় সামান্য আঘাতের কারণে হতে পারে, আবার কখনও কখনও এটি গুরুতর কোনো শারীরিক সমস্যা বা অসুস্থতার লক্ষণও হতে পারে। বুকের হাড় ব্যথার কারণগুলি জানা এবং সঠিক প্রতিকার গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
বুকের হাড় ব্যথার কারণ
১. কস্টোকোন্ড্রাইটিস (Costochondritis)
কস্টোকোন্ড্রাইটিস হল একটি সাধারণ অবস্থা, যেখানে বুকের হাড়ের সাথে পাঁজরের সংযোগস্থলের তরুণাস্থি বা কার্টিলেজে প্রদাহ দেখা দেয়। এই প্রদাহের ফলে বুকের হাড়ে ব্যথা অনুভূত হয়, যা হাঁটাহাঁটি, গভীর শ্বাস নেওয়া বা বুকের সাথে সম্পর্কিত কোনো কাজ করলে বাড়তে পারে।
২. মাংসপেশির টান বা আঘাত
যদি বুকের পেশিতে টান পড়ে বা আঘাত লাগে, তবে তা থেকে বুকের হাড়ের কাছে ব্যথা হতে পারে। ভারী কিছু তোলার সময় বা শরীরের কোনো অংশে অতিরিক্ত চাপ পড়লে এই ধরনের ব্যথা হতে পারে।
৩. হার্টবার্ন বা অ্যাসিড রিফ্লাক্স
হার্টবার্ন বা গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD)-এর কারণে পাকস্থলীর অ্যাসিড উপরের দিকে উঠে এসে বুকের হাড়ের আশেপাশে জ্বালাপোড়া বা ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের মতো অনুভূত হতে পারে, তাই এটি চিন্তার কারণ হতে পারে।
৪. হার্ট অ্যাটাক বা এনজাইনা (Angina)
যদি বুকের হাড়ের ব্যথা খুব তীব্র হয় এবং সাথে শ্বাসকষ্ট, ঘাম হওয়া বা বুকে চাপের অনুভূতি থাকে, তবে এটি হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে। হার্টের সমস্যা বা এনজাইনা হলে বুকের মাঝে বা বাম পাশে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
৫. প্লিউরাইটিস (Pleuritis)
ফুসফুস ও বুকের দেওয়ালের মধ্যে থাকা প্লিউরা নামক পর্দার প্রদাহকে প্লিউরাইটিস বলে। এর ফলে গভীর শ্বাস নেওয়ার সময় বা কাশি দিলে বুকের হাড়ের কাছে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এটি সাধারণত সংক্রমণ বা অন্যান্য ফুসফুসের সমস্যার কারণে ঘটে।
৬. ফ্র্যাকচার বা হাড় ভেঙে যাওয়া
যদি কোনো দুর্ঘটনায় বুকের হাড়ে আঘাত লাগে বা কোনোভাবে ফ্র্যাকচার হয়, তবে সেই অবস্থায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে। বুকের হাড় বা পাঁজরের হাড় ভেঙে গেলে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যথা স্থায়ী হতে পারে।
৭. স্ট্রেস বা অ্যাংজাইটি
স্ট্রেস বা উদ্বেগ অনেক সময় বুকের হাড়ে চাপ সৃষ্টি করে, যা ব্যথার কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ থাকলে বুকের পেশিতে সংকোচন হয়, যা ব্যথার অনুভূতি বাড়ায়।
বুকের হাড় ব্যথার প্রতিকার
১. বিশ্রাম ও পেশির আরাম
যদি বুকের ব্যথা মাংসপেশির টান বা আঘাতের কারণে হয়, তবে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং হালকা ব্যায়াম ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে। ব্যথা বাড়ার আশঙ্কা থাকলে ভারী কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
২. ঠান্ডা বা গরম সেঁক
বুকের পেশি বা হাড়ের ব্যথা কমাতে ঠান্ডা বা গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে। ঠান্ডা সেঁক দিলে প্রদাহ কমবে এবং ব্যথা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আবার, গরম সেঁক দিলে পেশির টান থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৩. ব্যথানাশক ওষুধ
যদি ব্যথা খুব বেশি হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথানাশক ওষুধ বা পেইনকিলার গ্রহণ করা যেতে পারে। অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ যেমন আইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রক্সেন ব্যবহারে প্রদাহ কমবে এবং ব্যথা লাঘব হবে।
৪. পেশির শিথিলকরণ ব্যায়াম
হালকা শারীরিক ব্যায়াম বা স্ট্রেচিং বুকের পেশির ব্যথা কমাতে সহায়ক হতে পারে। তবে ব্যায়াম করার সময় ধীরে ধীরে এবং সাবধানে করতে হবে, যাতে ব্যথা না বাড়ে।
৫. অ্যাসিড রিফ্লাক্স নিয়ন্ত্রণে রাখা
হার্টবার্ন বা অ্যাসিড রিফ্লাক্সের কারণে যদি ব্যথা হয়, তবে অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। ঝাল, টক, চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত এবং খাবার খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ বসে থাকা উচিত।
বুকের হাড় ব্যথার প্রতিরোধের উপায়
- শারীরিক কার্যকলাপ সঠিকভাবে করা: ভারী কিছু তোলার সময় বা ব্যায়াম করার সময় সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা জরুরি, যাতে পেশি বা হাড়ে চাপ না পড়ে।
- স্ট্রেস কমানো: মানসিক চাপ বা উদ্বেগ কমানোর জন্য মেডিটেশন বা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা যেতে পারে। স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে থাকলে বুকের ব্যথাও কমতে পারে।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা: অ্যাসিড রিফ্লাক্স এড়াতে স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।
- চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া: যদি ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা বাড়তে থাকে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সময়
- যদি বুকের ব্যথার সাথে শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব, অতিরিক্ত ঘাম, বা বুকে চাপ অনুভূত হয়।
- ব্যথা যদি বারবার ফিরে আসে বা কোনো ওষুধে প্রতিক্রিয়া না দেখায়।
- ব্যথার কারণে দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি হলে।
উপসংহার
বুকের হাড়ের ব্যথা কখনো সাধারণ কারণ, যেমন মাংসপেশির টান, আবার কখনো গুরুতর সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। সঠিক কারণ নির্ণয় করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তবে যদি ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা তীব্র হয়ে ওঠে, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।