ডায়রিয়া একটি সাধারণ কিন্তু কষ্টদায়ক স্বাস্থ্য সমস্যা যা বড়দের মধ্যে নানা কারণে হতে পারে। এটি মূলত জলীয় মলত্যাগের মাধ্যমে শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও খনিজ বের করে দেয়, ফলে দ্রুত পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এটি সামান্য হলেও, কখনো কখনো গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই ব্লগে আমরা বিশদভাবে জানবো বড়দের ডায়রিয়ার কারণ, লক্ষণ, করণীয় এবং প্রতিরোধের উপায়।
ডায়রিয়ার কারণ
বড়দের মধ্যে ডায়রিয়া হতে পারে বিভিন্ন কারণে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
- ভাইরাসজনিত সংক্রমণ – নরোভাইরাস ও রোটাভাইরাসের মতো ভাইরাস ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ।
- ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ – দূষিত খাবার ও পানীয়র মাধ্যমে সালমোনেলা, ই-কোলাই, কিংবা শিগেলা সংক্রমিত হতে পারে।
- পরজীবী সংক্রমণ – জিয়ার্ডিয়া ও আমিবিয়াসিসের মতো পরজীবী সংক্রমণ ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে।
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা ক্যাফেইন গ্রহণ – বেশি চা, কফি বা অ্যালকোহল পান করলে পেটের পিএইচ ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
- খাদ্যে অ্যালার্জি বা অসহনশীলতা – যেমন, দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য খেলে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স থাকলে ডায়রিয়া হতে পারে।
- অতিরিক্ত ওষুধ গ্রহণ – অ্যান্টিবায়োটিক বা ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ওষুধ ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে।
- মানসিক চাপ ও উদ্বেগ – মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা অনেক সময় পেটের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
- অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার বা রাসায়নিক সংমিশ্রিত খাবার গ্রহণ – এটি অন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত করে ডায়রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
ডায়রিয়ার লক্ষণ
ডায়রিয়া হলে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়—
- বারবার পানির মতো মলত্যাগ
- পেট ব্যথা ও পেট ফাঁপা
- বমিভাব বা বমি
- জ্বর (কিছু ক্ষেত্রে)
- শরীরে পানিশূন্যতার লক্ষণ (মুখ শুকিয়ে যাওয়া, দুর্বলতা, ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা কমে যাওয়া)
- ক্ষুধামন্দা
যদি এই লক্ষণগুলোর পাশাপাশি রক্তযুক্ত মলত্যাগ, তীব্র পেটব্যথা বা অতিরিক্ত দুর্বলতা দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
বড়দের ডায়রিয়া হলে করণীয়
১. পর্যাপ্ত পানি ও ওরস্যালাইন গ্রহণ করুন
ডায়রিয়ার ফলে শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে, তাই পানির পরিমাণ বাড়ানো খুবই জরুরি। ওরস্যালাইন (ORS) পান করলে শরীরে পানির ভারসাম্য রক্ষা হয়। এছাড়া নারকেলের পানি, লবণ-চিনি মিশ্রিত পানি, ফ্লেভার্ড ওয়াটার বা ডাবের পানি খাওয়া যেতে পারে।
২. হালকা ও সহজপাচ্য খাবার খান
ডায়রিয়া হলে ভারী খাবার এড়িয়ে হালকা খাবার খাওয়া উচিত, যেমন—
- ভাতের মাড়
- সিদ্ধ আলু
- কলা
- টোস্ট
- সেদ্ধ ডাল
- স্যুপ
৩. ক্যাফেইন ও দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলুন
চা, কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার অন্ত্রের জন্য বেশি চাপে ফেলে এবং ডায়রিয়াকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
৪. প্রোবায়োটিকস গ্রহণ করুন
প্রোবায়োটিকসমৃদ্ধ খাবার (যেমন, দই) অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে এবং দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়তা করে।
৫. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন
শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে গেলে দুর্বলতা দেখা দিতে পারে, তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি।
৬. সংক্রমণ এড়াতে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
ডায়রিয়া ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়াতে পারে, তাই প্রতিবার টয়লেট ব্যবহারের পর এবং খাবারের আগে ভালোভাবে হাত ধোয়া উচিত।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি?
যদি নিম্নলিখিত কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত—
ডায়রিয়া তিন দিনের বেশি স্থায়ী হলে
প্রচণ্ড পেটব্যথা থাকলে
মলের সাথে রক্ত গেলে
অতিরিক্ত দুর্বলতা বা মাথা ঘোরা অনুভূত হলে
প্রচণ্ড পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে
ডায়রিয়া প্রতিরোধের উপায়
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার গ্রহণ করুন: রাস্তার খাবার ও অপরিষ্কার পানি এড়িয়ে চলুন।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন: বেশি ভাজা-তেলে ভাজা খাবার ও অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার কম খাওয়া উচিত।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন: বিশুদ্ধ পানি পান করা জরুরি।
ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন: খাবার খাওয়ার আগে ও টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধোয়া উচিত।
সঠিক ওষুধ গ্রহণ করুন: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করবেন না, কারণ এটি অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে নষ্ট করতে পারে।
উপসংহার
ডায়রিয়া একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এটি অবহেলা করলে গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই দ্রুত আরোগ্যের জন্য পর্যাপ্ত পানি ও ওরস্যালাইন পান করা, সহজপাচ্য খাবার খাওয়া এবং বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি, প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও পরিচ্ছন্নতা মেনে চললে ডায়রিয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।