গর্ভাবস্থায় রক্তপাত একটি সাধারণ ঘটনা হলেও এটি গর্ভবতী নারীদের জন্য বেশ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসের রক্তপাত নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন থাকেন। তবে গর্ভাবস্থার যেকোনো পর্যায়ে রক্তপাত হলে তা অবহেলা করা উচিত নয়। এটি কখনো স্বাভাবিক হতে পারে, আবার কখনো এটি গর্ভের জটিলতার ইঙ্গিতও দিতে পারে। তাই রক্তপাত হলে তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
গর্ভাবস্থায় রক্তপাতের কারণ
গর্ভাবস্থার বিভিন্ন সময়ে রক্তপাতের বিভিন্ন কারণ হতে পারে। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে এবং শেষের দিকে রক্তপাতের কারণগুলো ভিন্ন হতে পারে।
প্রথম তিন মাসে রক্তপাতের কারণসমূহ:
- ইমপ্লান্টেশন ব্লিডিং: গর্ভধারণের ৬-১২ দিন পর ডিম্বাণুটি জরায়ুর গায়ে আটকে গেলে হালকা রক্তপাত হতে পারে। এটি সাধারণত কম পরিমাণে হয় এবং কয়েক দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।
- অসুস্থ গর্ভাবস্থা (মিসক্যারেজ): গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে রক্তপাত মিসক্যারেজের লক্ষণ হতে পারে। এতে সাধারণত পেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা মাথা ঘোরা দেখা দেয়।
- অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি: যখন ডিম্বাণুটি জরায়ুর বাইরে, বিশেষ করে ফ্যালোপিয়ান টিউবে আটকে যায়, তখন রক্তপাত হতে পারে। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং জরুরিভাবে চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
শেষ তিন মাসে রক্তপাতের কারণসমূহ:
- প্লাসেন্টা প্রিভিয়া: প্লাসেন্টা জরায়ুর মুখে অবস্থান করলে রক্তপাত হতে পারে। এটি তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ঘটে থাকে এবং এর জন্য দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
- প্লাসেন্টাল অ্যাব্রাপশন: জরায়ুর দেয়াল থেকে প্লাসেন্টা আলগা হয়ে গেলে রক্তপাত শুরু হতে পারে। এটি মায়ের এবং শিশুর উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে।
- প্রি-টার্ম লেবার: নির্ধারিত সময়ের আগেই যদি প্রসব বেদনা শুরু হয় তবে রক্তপাত দেখা দিতে পারে। এতে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হলে করণীয়
১. শারীরিক বিশ্রাম নিন
রক্তপাত হলে তাৎক্ষণিকভাবে শারীরিক বিশ্রাম নেওয়া উচিত। যতটা সম্ভব শুয়ে থাকুন এবং ভারী কাজ থেকে বিরত থাকুন। ভারী কাজ করলে রক্তপাত বেড়ে যেতে পারে এবং সমস্যার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
২. প্রচুর পানি পান করুন
রক্তপাত হলে শরীর থেকে অতিরিক্ত তরল বের হয়ে যেতে পারে। তাই শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা জরুরি। এতে শরীর আর্দ্র থাকে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৩. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হলে দেরি না করে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। চিকিৎসক আল্ট্রাসাউন্ড বা অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তপাতের কারণ নির্ণয় করবেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেবেন।
৪. শারীরিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলুন
রক্তপাত হলে শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ এতে রক্তপাতের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে এবং জরায়ুর চাপ বাড়তে পারে।
৫. মানসিকভাবে শান্ত থাকুন
রক্তপাত হলে মনের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে মানসিকভাবে শান্ত থাকা অত্যন্ত জরুরি। অহেতুক দুশ্চিন্তা করলে শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মেডিক্যাল সহায়তা নেওয়ার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিন, তবে অযথা মানসিক চাপ সৃষ্টি করবেন না।
৬. সঠিক ওষুধ সেবন করুন
চিকিৎসক যদি আপনাকে কোনো ওষুধ দেন, তবে তা নিয়মিতভাবে এবং সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করুন। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে থেকে ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৭. জরুরী চিকিৎসার ব্যবস্থা নিন
যদি রক্তপাত খুব বেশি হয়, বা তার সাথে তীব্র পেট ব্যথা, মাথা ঘোরা, বা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তাহলে দেরি না করে জরুরী চিকিৎসা নিন। এটি মারাত্মক সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে, যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন।
রক্তপাত প্রতিরোধে করণীয়
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান: গর্ভাবস্থায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত। এতে জরায়ুর স্বাস্থ্য এবং গর্ভের শিশুর অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়।
- পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন: পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং রক্তপাতের ঝুঁকি কমে।
- মৃদু ব্যায়াম করুন: হালকা ব্যায়াম করলে শরীর ফিট থাকে এবং গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত চাপ কমে। তবে ব্যায়াম করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন: গর্ভাবস্থায় ধূমপান ও অ্যালকোহল রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এগুলি থেকে দূরে থাকা উচিত।
গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হলে তাৎক্ষণিকভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। রক্তপাত সবসময়ই বিপদের কারণ হতে পারে না, তবে এটি উপেক্ষা করাও উচিত নয়। সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া গর্ভের সন্তানের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করুন।