সংসার ভাঙনের মূল কারণ কী? ব্রিটেনের বাস্তবতা

ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশি এবং অন্যান্য অভিবাসী দম্পতিদের মধ্যে সংসার ভাঙন একটি উদ্বেগজনক সমস্যা হয়ে উঠেছে। যেহেতু ব্রিটেনে একটি বহুজাতিক এবং বৈচিত্র্যময় সমাজ, এখানে দম্পতির সম্পর্কের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক চাপ কাজ করে। সংসারের টানাপোড়েন এবং ভাঙনের পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, সাংস্কৃতিক পার্থক্য, আর্থিক সমস্যা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ অন্যতম। এই কারণগুলোর প্রভাব দম্পতিদের মধ্যে দূরত্ব এবং সম্পর্কের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা অবশেষে সংসার ভাঙনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। চলুন, দেখে নেওয়া যাক ব্রিটেনের বাস্তবতায় সংসার ভাঙনের মূল কারণ কী এবং কীভাবে এর সমাধান করা যেতে পারে।

১. সাংস্কৃতিক পার্থক্য

ব্রিটেনে এসে অনেক বাংলাদেশি দম্পতি তাদের নিজ দেশের সংস্কৃতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলতে গিয়ে তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। পরিবারের সদস্যদের পুরনো চিন্তা-ধারা এবং ব্রিটিশ সমাজের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের অমিল দেখা দেয়। বিশেষত, যখন দম্পতির মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য ব্যাপক হয়ে ওঠে, তখন এটি সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এই দ্বন্দ্ব সম্পর্কের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয় এবং সংসারের ভাঙন ঘটাতে পারে।

raju akon youtube channel subscribtion

২. ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা

ব্রিটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশি দম্পতিদের মধ্যে ভাষাগত সমস্যা সম্পর্কের মধ্যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও অনেকেই ইংরেজি জানেন, কিন্তু পুরোপুরি সাবলীল না হওয়া তাদের জন্য চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। একে অপরের অনুভূতিকে সঠিকভাবে বোঝা না গেলে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়, এবং সম্পর্কের গুণগত মান কমে যায়। এই ধরনের অস্পষ্টতা এবং ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্কের মধ্যে দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে।

৩. অর্থনৈতিক চাপ

ব্রিটেনের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি, এবং প্রবাসী দম্পতিরা বিশেষত তাদের প্রথম বছরগুলোতে আর্থিক চাপের মধ্যে থাকতে পারেন। অনেক সময় তারা কম আয়ে জীবনযাপন করেন এবং সংসারের সব দায়িত্ব সামলাতে তাদের কাছে চাপ বেশি হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা দম্পতির মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি করে, যা সম্পর্কের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। উচ্চ ভাড়া, সন্তানদের শিক্ষা, খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য সঙ্গী একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল থাকে, তবে যদি একজনের আয়ে ঘাটতি থাকে, তবে সেটা সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে।

৪. পরিবার থেকে দূরত্ব এবং একাকীত্ব

ব্রিটেনে এসে অনেক বাংলাদেশি দম্পতি তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। একে অপরের মধ্যে সম্পর্কের দুর্বলতা এবং একাকীত্ব অনুভূতির কারণে অনেক সময় দম্পতির মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষত, যারা নতুন প্রজন্মের সদস্য এবং তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখেন না, তাদের মধ্যে একাকীত্ব অনুভব হতে পারে। একাকীত্বের অনুভূতি, বিশেষ করে যাদের একে অপরের প্রতি মনোযোগ কমে গেছে, তা সংসারের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে।

৫. পারিবারিক প্রত্যাশা এবং চাপ

বাংলাদেশি কমিউনিটিতে পরিবারের প্রত্যাশা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। অনেক অভিবাসী দম্পতি তাদের পরিবারের সদস্যদের চাহিদা এবং প্রত্যাশা পূরণের জন্য অতিরিক্ত চাপ অনুভব করেন। প্রবাসী দম্পতিরা বিশেষত তাদের পরিবারকে সমর্থন দিতে গিয়ে নিজেদের সম্পর্কের প্রতি খেয়াল কমিয়ে ফেলতে পারেন। সন্তানদের শিক্ষা, বাড়ির খরচ এবং পরিবারের দুশ্চিন্তা এতটাই চাপ সৃষ্টি করতে পারে যে, দম্পতির মধ্যে সম্পর্কের প্রতি মনোযোগ কমে যায়।

৬. মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা

ব্রিটেনে বসবাসরত অনেক বাংলাদেশি দম্পতি মানসিক চাপ, উদ্বেগ, এবং বিষণ্ণতার শিকার হন। নতুন দেশে এসে একাকীত্ব, সাংস্কৃতিক অস্থিরতা এবং ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগে পড়েন। যখন একজনের মানসিক অবস্থা খারাপ হয়, তখন সম্পর্কের ওপরও তার প্রভাব পড়ে। যেহেতু অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে সংকোচ করেন, তাই সমস্যাগুলি সমাধান না হওয়ার কারণে সম্পর্কের ভাঙন আরও বাড়তে পারে।

৭. বাচ্চাদের শিক্ষা এবং সংস্কৃতি সংক্রান্ত পার্থক্য

ব্রিটেনের স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি, সন্তানদের মধ্যে ব্রিটিশ সমাজের মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসতে থাকে, যা পিতামাতার পুরনো ধারণার সাথে মেলে না। সন্তানদের শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ এবং জীবনযাপনের বিষয়ে পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সন্তানের চিন্তাভাবনা এক হয়ে না গেলে, এটি দম্পতির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে। কখনো কখনো, একজন বাবা-মা তাদের সন্তানদের সম্পর্কে একমত হতে পারেন না, যা সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

সমাধান: কীভাবে সংসারের সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব?

  1. খোলামেলা যোগাযোগ: দম্পতির মধ্যে সৎ ও খোলামেলা আলোচনা সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব কমাতে সাহায্য করতে পারে। তাদের অনুভূতি এবং উদ্বেগ শেয়ার করা একে অপরকে বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  2. পারস্পরিক সমর্থন: অর্থনৈতিক, মানসিক এবং পারিবারিক চাপের সময় একে অপরকে সমর্থন করা উচিত। দম্পতির মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব সম্পর্কের ভিতকে দৃঢ় করতে সাহায্য করে।
  3. মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে পেশাদার কাউন্সেলিং সেবা গ্রহণ করা উচিত। আমি, রাজু আকন (কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট), আপনাকে মানসিক চাপ মোকাবেলা করতে সাহায্য করতে প্রস্তুত। আপনি rajuakon.com/contact-এ যোগাযোগ করে সেবা নিতে পারেন।
  4. সামাজিক সম্পর্ক গঠন: ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশি দম্পতির জন্য সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং একে অপরকে সহায়তা করা গুরুত্বপূর্ণ। কমিউনিটি গ্রুপ এবং বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে।

ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশি দম্পতিদের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করে। সাংস্কৃতিক পার্থক্য, অর্থনৈতিক চাপ, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা এবং পারিবারিক প্রত্যাশা সম্পর্কের অস্থিরতার কারণ হতে পারে। তবে, খোলামেলা যোগাযোগ, পারস্পরিক সমর্থন, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। সম্পর্কের দৃঢ়তা বজায় রাখার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top