ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতি কোনটি?

মানসিক রোগের চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে তুলেছে। তবে অতীতের ইতিহাসে এমন কিছু মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে যা বর্তমান যুগে কল্পনাতীত। এগুলোর বেশিরভাগই ছিল অত্যন্ত নির্দয়, কষ্টদায়ক, এবং অনৈতিক। ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি ছিল লোবোটোমি (Lobotomy)।

লোবোটোমি: মানসিক চিকিৎসার এক দুঃস্বপ্ন
লোবোটোমি ছিল এমন একটি শল্যচিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের (প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স) একটি অংশ কেটে বা ধ্বংস করে ফেলা হতো। ১৯৩৫ সালে ডঃ ইগাস মনিজ নামক এক পর্তুগিজ স্নায়ু বিশেষজ্ঞ প্রথম এই পদ্ধতির সূচনা করেন। তখনকার দিনে এটি মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত, বিশেষত স্কিজোফ্রেনিয়া, বিষণ্ণতা, এবং অতিরিক্ত উত্তেজনার রোগীদের ক্ষেত্রে। যদিও লোবোটোমি করার পর রোগীদের অনেকাংশে শান্ত দেখা যেত, তাদের ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিমত্তা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো।

raju akon youtube channel subscribtion

লোবোটোমির পদ্ধতি
লোবোটোমি মূলত দুটি পদ্ধতিতে করা হতো:

প্রি-ফ্রন্টাল লোবোটোমি: প্রথমে রোগীর মাথার খুলির একাংশ কেটে ফেলে মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সে অস্ত্রোপচার করা হত।
ট্রান্স-অরবিটাল লোবোটোমি: এই পদ্ধতিতে রোগীর চোখের কোটরের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কের অংশ কেটে বা ধ্বংস করা হত। এটি ছিল আরও ভয়ংকর কারণ এতে কোনও বড় শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতো না, বরং একটি আয়েসক খুঁচানোর মতো সরঞ্জাম ব্যবহার করা হত।
কেন লোবোটোমি এত ভয়ংকর ছিল?
লোবোটোমির পর মানসিক রোগীরা হয়ত কম উত্তেজিত হতেন, কিন্তু এটি তাদের মানসিক ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিত। রোগীরা কথা বলার ক্ষমতা, চিন্তা করার ক্ষমতা, এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতেন। অনেক সময় তারা পুরোপুরি নির্জীব হয়ে যেতেন। এছাড়াও, অনেক রোগীর মৃত্যু হত অস্ত্রোপচারের পরের জটিলতায়।

লোবোটোমির পরিণাম এবং নিষিদ্ধকরণ
১৯৪০-এর দশকে এই পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলেও, ১৯৫০-এর দশকে ধীরে ধীরে লোবোটোমি পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। মানসিক রোগীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য এটি নিষিদ্ধ করা হয় এবং অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধের উদ্ভাবন এবং আধুনিক মনোরোগ চিকিৎসার উন্নতির কারণে লোবোটোমির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে আসে।

ইতিহাসের অন্য কিছু ভয়ংকর মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতি
লোবোটোমি ছাড়াও ইতিহাসে আরও কিছু ভয়ংকর মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল, যেমন:

ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ইসিটি): প্রাথমিক পর্যায়ে ইলেক্ট্রিক শকের মাধ্যমে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করা হত। এটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ছিল এবং এর ফলে রোগীদের মনে ট্রমা সৃষ্টি হতো।
ইনসুলিন শক থেরাপি: ইনসুলিনের মাধ্যমে রোগীদের কোমাতে নিয়ে যাওয়া হত। এই পদ্ধতি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং প্রাণঘাতী ছিল।
রোটেশন থেরাপি: রোগীদের একটি চেয়ারে বসিয়ে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় রাখা হতো। এটি মূলত মানসিক অবস্থাকে শান্ত করার জন্য ব্যবহৃত হলেও এর ফলে রোগীদের প্রচণ্ড মাথাব্যথা এবং বমি হতো।
উপসংহার
মানসিক রোগের চিকিৎসার ইতিহাসে লোবোটোমি ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর এবং নির্দয় পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমান যুগে মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরও উন্নত এবং মানবিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। ইতিহাসের এই শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বিজ্ঞান এবং চিকিৎসার অগ্রগতি কেবল প্রযুক্তিগত নয়, এটি মানবিক এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top