সন্তান নেওয়া একজন দম্পতির জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এটি শুধু জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা নয়, বরং শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার একটি সময়। সন্তান নেওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করলে ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি সুস্থ এবং সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে পারে।
১. শারীরিক প্রস্তুতি
স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান
সন্তান নেওয়ার আগে নারী এবং পুরুষ উভয়েরই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নারীদের গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কিছু মৌলিক পরীক্ষা যেমন রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরীক্ষা করা আবশ্যক। পুরুষদেরও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত, বিশেষত যদি কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে যা প্রজনন ক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রয়োজনীয় টিকা গ্রহণ
সন্তান ধারণের আগে কিছু প্রয়োজনীয় টিকা গ্রহণ করা জরুরি। কিছু রোগ যেমন রুবেলা বা হেপাটাইটিস বি গর্ভাবস্থায় শিশুর জন্য বিপদজনক হতে পারে। তাই, এই ধরনের রোগের বিরুদ্ধে টিকা নেওয়া উচিত।
সঠিক ওজন বজায় রাখুন
সন্তান ধারণের আগে সঠিক ওজন বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত ওজন বা ওজন কম থাকা উভয়ই গর্ভধারণে সমস্যা তৈরি করতে পারে এবং গর্ভাবস্থায় জটিলতার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। সঠিক ডায়েট এবং হালকা ব্যায়াম করে সঠিক ওজন বজায় রাখতে হবে।
ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন গ্রহণ
গর্ভধারণের পূর্বে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করলে শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের গঠন সঠিকভাবে হয় এবং নিউরাল টিউব ডিফেক্টের ঝুঁকি কমে। এছাড়া ভিটামিন ডি এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবারও গর্ভধারণের পূর্বে খাওয়া উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকুন
ধূমপান, অ্যালকোহল, এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য গর্ভধারণের সক্ষমতা হ্রাস করতে পারে এবং ভবিষ্যতে শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই, গর্ভধারণের আগে থেকেই এগুলো থেকে বিরত থাকা উচিত।
২. মানসিক প্রস্তুতি
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ
গর্ভধারণ একটি আবেগপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং সময় হতে পারে। তাই, সন্তান নেওয়ার আগে মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া খুবই জরুরি। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে শারীরিক ব্যায়াম, মেডিটেশন, এবং সঠিক বিশ্রাম নিতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করে মানসিক চাপ কমানো যেতে পারে।
সন্তান লালনের পরিকল্পনা
সন্তান লালন-পালনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা অত্যন্ত জরুরি। দম্পতিকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে যে তারা সন্তান লালনের দায়িত্ব কীভাবে ভাগাভাগি করবেন, এবং সন্তান আসার পর তাদের জীবনযাত্রায় কী পরিবর্তন আসতে পারে।
আর্থিক প্রস্তুতি
সন্তান নেওয়ার আগে আর্থিক দিক থেকেও পরিকল্পনা করা উচিত। গর্ভাবস্থার সময় এবং সন্তানের জন্মের পর খরচ অনেক বেড়ে যেতে পারে। তাই আগে থেকেই বাজেট তৈরি করে আর্থিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত। স্বাস্থ্যবীমা, চিকিৎসার খরচ, এবং ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় রাখা প্রয়োজন।
৩. সঠিক খাদ্যাভ্যাস
পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ
সন্তান ধারণের পূর্বে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। প্রোটিন, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করলে শরীর সুস্থ থাকে এবং গর্ভাবস্থা ভালোভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়। ভাজা-পোড়া এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করা উচিত।
পানি পান
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করলে শরীর আর্দ্র থাকে এবং প্রজনন ক্ষমতা সঠিক থাকে। পানি শরীর থেকে টক্সিন দূর করতে সহায়ক এবং গর্ভধারণের পূর্বে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৪. ব্যায়াম এবং শারীরিক সক্রিয়তা
নিয়মিত ব্যায়াম
গর্ভধারণের আগে নিয়মিত ব্যায়াম শরীরকে ফিট রাখতে সাহায্য করে। হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটা, ইয়োগা, বা সুইমিং করা যেতে পারে। এতে শারীরিক ফিটনেস বজায় থাকে এবং গর্ভধারণের সময় জটিলতার ঝুঁকি কমে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম
সন্তান নেওয়ার আগে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিশ্রাম নিলে শরীর এবং মন উভয়ই সুস্থ থাকে। পর্যাপ্ত ঘুম এবং শারীরিক ক্লান্তি কমানোর জন্য বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সন্তান নেওয়া জীবনের একটি বড় দায়িত্ব। শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে প্রস্তুত হলে গর্ভধারণ এবং সন্তানের জন্মের সময়টি সহজতর ও আনন্দময় হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুষ্টিকর খাবার, ব্যায়াম, এবং মানসিক প্রস্তুতি—এই সবকিছু মিলিয়ে সন্তান নেওয়ার প্রস্তুতি সফলভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হবে। দম্পতির উভয়েরই সমানভাবে এই প্রস্তুতির দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়া উচিত, যাতে একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবার গড়ে তোলা যায়।