মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অনেক ধরনের ভুল ধারণা এবং কুসংস্কার বিদ্যমান। এসব ভুল ধারণা মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বকে খাটো করে তোলে এবং মানুষকে সঠিক সময়ে সেবা গ্রহণ থেকে বিরত রাখে। আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রথমে এসব ভুল ধারণাগুলোকে চিহ্নিত করা জরুরি। চলুন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা এবং তাদের পেছনের বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করি।
১. মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা শুধু দুর্বল মানুষদের হয়
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা হলো, এটি শুধু মানসিকভাবে দুর্বল মানুষদের হয়। বাস্তবতা হলো, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যে কারও হতে পারে, তা সে মানসিকভাবে যতই শক্তিশালী হোক না কেন। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার পেছনে জিনগত, পরিবেশগত এবং মানসিক চাপসহ বিভিন্ন কারণ থাকে। এটি কোনো দুর্বলতার লক্ষণ নয়, বরং একটি চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা।
২. মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য কাউন্সেলিং বা থেরাপি অকার্যকর
অনেকেই মনে করেন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য কাউন্সেলিং বা থেরাপি কোনো কাজে আসে না, বরং শুধু ওষুধেই সমাধান সম্ভব। তবে এ ধারণা ভুল। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং বা থেরাপি অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। থেরাপির মাধ্যমে মানুষ তাদের মানসিক সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল শিখতে পারেন এবং ধীরে ধীরে তাদের মানসিক চাপ কমাতে পারেন। ওষুধ এবং থেরাপি একত্রে কাজ করলে অনেক ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৩. মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মানুষ সব সময় বিপজ্জনক
এটি একটি প্রচলিত ভুল ধারণা যে মানসিক সমস্যা নিয়ে বসবাস করা মানুষ সব সময় বিপজ্জনক এবং সহিংস আচরণ করেন। বাস্তবে বেশিরভাগ মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সহিংস নন, বরং তারা নিজেরাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হন। যদিও কিছু গুরুতর মানসিক সমস্যা সহিংস আচরণ সৃষ্টি করতে পারে, তবে এটি খুবই বিরল। সঠিক চিকিৎসা এবং সহায়তা পেলে এ ধরনের আচরণও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
৪. মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দূর করতে শুধুমাত্র ইতিবাচক চিন্তাই যথেষ্ট
অনেকেই মনে করেন যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো শুধুমাত্র ইতিবাচক চিন্তাভাবনা বা সঠিক মনোভাবের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। যদিও ইতিবাচক মনোভাব মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক, তবে এটি সবসময় যথেষ্ট নয়। হতাশা, উদ্বেগ, বা অন্যান্য মানসিক সমস্যার জন্য প্রয়োজন পেশাদার চিকিৎসা, থেরাপি, এবং কখনো কখনো ওষুধের। মানসিক সমস্যাগুলো শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তি দিয়ে দূর করা সম্ভব নয়।
৫. শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হয় না
অনেকেই মনে করেন যে শিশু এবং কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে না, এবং তারা সব সময়ই সুখী ও সুস্থ থাকে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু-কিশোরদের মধ্যেও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্কুলের চাপ, পরিবারিক সমস্যা, এবং সমাজের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে তারা মানসিক চাপের মুখোমুখি হতে পারে। তাই শিশুদের মানসিক সমস্যা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা এবং তাদের যথাযথ সহায়তা দেওয়া জরুরি।
৬. মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কথা বললে লজ্জা পাওয়া উচিত
এটি একটি সামাজিক কুসংস্কার যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কথা বলা লজ্জাজনক। বাস্তবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা একটি সাধারণ বিষয় এবং এটি নিয়ে কথা বলা উচিত। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সমর্থন বাড়াতে খোলাখুলি আলোচনা প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কথা বললে মানুষ সঠিক সময়ে সহায়তা পেতে পারেন এবং সবার মধ্যে একটি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়।
৭. মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা স্থায়ী এবং নিরাময়যোগ্য নয়
অনেকেই মনে করেন যে একবার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হলে তা সারাজীবন থাকবে এবং এর নিরাময় সম্ভব নয়। বাস্তবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিরাময়যোগ্য এবং নিয়মিত চিকিৎসা ও সহায়তার মাধ্যমে মানুষ সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন। ঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে মানসিক সমস্যাগুলো অনেকাংশেই সমাধান করা সম্ভব।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিদ্যমান ভুল ধারণাগুলো সমাজে সচেতনতার অভাব এবং মানসিক সমস্যাগুলোর যথাযথ ব্যাখ্যার অভাবে তৈরি হয়েছে। এই ভুল ধারণাগুলো দূর করে মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা স্বাভাবিক একটি অবস্থা, যা সঠিক চিকিৎসা ও সহায়তার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। সবার উচিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে গুরুত্বের সাথে দেখা এবং সঠিক সময়ে সহায়তা গ্রহণ করা।