দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম বড় শহর, যেখানে হাজার হাজার বাংলাদেশি পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে আসে। অনেক বাংলাদেশি শিশু এখানে জন্ম নেয় এবং বড় হয়। দুবাইয়ের উন্নত জীবনযাত্রা, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং বৈদেশিক সংস্কৃতির মিলনস্থলে বেড়ে ওঠা এই শিশুদের জন্য কিছু মানসিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের পরিবার থেকে দূরে থাকাকালীন, এসব শিশু নানা ধরনের মানসিক সমস্যার শিকার হতে পারে, বিশেষ করে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি, একাকীত্ব এবং পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা।
এই ব্লগে, আমরা আলোচনা করব, দুবাইয়ে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং তাদের অভিজ্ঞতার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে।
১. ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা
১.১ ভাষা শেখার চ্যালেঞ্জ
দুবাইয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি শিশুরা সাধারণত বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় দক্ষ নয়। দুবাইয়ে স্থানীয় ভাষা আরবি এবং ইংরেজি প্রচলিত ভাষা, কিন্তু অনেক শিশু তাদের মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারে না। এটি তাদের স্কুলে এবং সামাজিক পরিবেশে মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে, শিশুরা ক্লাসে অংশ নিতে, বন্ধু তৈরি করতে এবং তাদের চিন্তা প্রকাশ করতে সমস্যা অনুভব করতে পারে, যা তাদের আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১.২ ভাষাগত সংলাপের অভাব
বাংলাদেশি শিশুদের মধ্যে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ অনুভূতি বা সমস্যা সহজে মনের কথা বলতেও সংকুচিত হতে পারে। স্থানীয় সমাজে মিশে না পারার কারণে, তারা নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক এবং একাকী অনুভব করতে পারে, যা মানসিক অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে।
২. সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি এবং মানসিক চাপ
২.১ বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা
দুবাইয়ের মতো বহুজাতিক সমাজে বাংলাদেশি শিশুরা বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠে। এই শিশুদের জন্য স্থানীয় আরবি সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতির সংমিশ্রণ একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। শিশু যখন তাদের পরিবার বা সম্প্রদায়ের পরিচয়ের বাইরে চলে যায় এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়, তখন তারা অনেক সময় বিভ্রান্তি অনুভব করতে পারে। বিশেষত, তারা তাদের পরিচয় নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারে, যেমন একদিকে নিজেদের বাংলাদেশি মনে হলেও, অন্যদিকে তারা স্থানীয় সমাজে মিশে না উঠতে পারে।
২.২ পরিবার ও সমাজের মধ্যে চাপ
বাংলাদেশি শিশুরা মাঝে মাঝে তাদের পরিবারের প্রতিশ্রুতি এবং স্থানীয় সমাজের চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না। পরিবার থেকে অনেক সময় কিছু অতিরিক্ত চাপ থাকে যেমন পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জন করা বা সঠিক আচার-আচরণ বজায় রাখা, যা মানসিক চাপ তৈরি করে। অন্যদিকে, তারা স্থানীয় সমাজের সঙ্গে মিশতে গেলে তাদের এক ধরনের সামাজিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে পারে।
৩. পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্ব
৩.১ পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা
বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি প্রবাসী পরিবার দুবাইতে বসবাস করে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারগুলোর সদস্যরা একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। শিশুদের বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যরা যখন একে অপরের সঙ্গে কম সময় কাটান বা দূরত্বে থাকেন, তখন একাকীত্ব এবং বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়ে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে শিশুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা আসে।
৩.২ দূরের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক
অনেক বাংলাদেশি শিশু তাদের পিতামাতার কাছ থেকে দূরে, দাদী-দাদার বা অন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকে। এই ধরনের পারিবারিক ব্যবস্থাও তাদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত যদি তারা পরিবারের কাছে যেতে না পারে বা পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ না থাকে।
৪. শিক্ষাগত চাপ ও মানসিক সুস্থতা
৪.১ শিক্ষায় চাপ
দুবাইয়ের স্কুলে অনেক সময় স্থানীয় পাঠ্যক্রমের সাথে মানিয়ে চলতে বা আন্তর্জাতিক ভাষা শিখতে শিশুদের জন্য চাপ সৃষ্টি হয়। স্থানীয় ভাষা আরবি বা ইংরেজি না জানার কারণে, তাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। শিক্ষাগত চাপ, বিশেষত অভিভাবকদের উচ্চ প্রত্যাশা, শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে। চাপের কারণে তারা বিষণ্ণতার শিকার হতে পারে, এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব হতে পারে।
৪.২ স্কুলে সামাজিক সমস্যা
যেহেতু তারা স্থানীয় ভাষায় পুরোপুরি দক্ষ নয়, তাই তাদের স্কুলে সহপাঠীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে সমস্যা হতে পারে। এটি তাদের মধ্যে একাকীত্ব এবং মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত স্কুলে বা সমাজে তাদের অবাঞ্ছিত বা অপরিচিত মনে হলে।
৫. মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার উপায়
৫.১ ভাষাগত দক্ষতা উন্নয়ন
শিশুদের ভাষাগত দক্ষতা উন্নত করতে তাদের স্থানীয় ভাষা এবং ইংরেজি শিখতে সহায়তা করা উচিত। এটা তাদের শিক্ষায় সহায়ক হবে এবং স্কুলে মানসিক চাপ কমাবে। ভাষা শেখার মাধ্যমে তারা স্থানীয় সমাজে একীভূত হতে পারবে এবং আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে।
৫.২ পারিবারিক সমর্থন
শিশুর মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মা তাদের সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে এবং তাদের অনুভূতি শেয়ার করতে সহায়তা করতে পারেন। পরিবারের সঠিক সমর্থন এবং ভালোবাসা মানসিক চাপ কাটাতে সাহায্য করবে এবং একাকীত্ব দূর করবে।
৫.৩ সামাজিকীকরণ এবং বন্ধুত্ব গড়া
বাচ্চাদের উচিত বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা এবং স্কুল বা সমাজে অংশগ্রহণ করা। বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম, খেলাধুলা, বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ তাদের আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক বিকাশে সহায়ক হতে পারে।
৫.৪ পেশাদার সহায়তা গ্রহণ করা
যদি কোনও শিশু মানসিক চাপ বা উদ্বেগ অনুভব করে, তবে পেশাদার সহায়তা নেওয়া উচিত। rajuakon.com/contact এর মাধ্যমে অনলাইন কাউন্সেলিং সেবা নেওয়া যেতে পারে, যা গোপনীয় এবং নিরাপদ পরিবেশে মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হবে।
দুবাইতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি শিশুদের জন্য বেশ কিছু মানসিক চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে, বিশেষত ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, সাংস্কৃতিক পার্থক্য, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং শিক্ষাগত চাপ। তবে, সঠিক সমর্থন, ভাষাগত দক্ষতা, সামাজিকীকরণ এবং পারিবারিক বন্ধন নিশ্চিত করে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। প্রবাসী শিশুদের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য পরিবার এবং সমাজের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।