মানসিক স্বাস্থ্য ও কুসংস্কার

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নানা ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এসব কুসংস্কার মানসিক সমস্যার সঠিক চিকিৎসা ও প্রতিকারকে বাধাগ্রস্ত করে। মানসিক রোগকে অনেক সময় “অভিশাপ” বা “ভূতের ছোঁয়া” হিসেবে ধরা হয়, যা মানসিক রোগীদের জীবনকে আরো কঠিন করে তোলে।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কার

  1. “ভূত-প্রেতের প্রভাব”: গ্রামাঞ্চলে এবং কিছু শহরাঞ্চলেও এখনও অনেক মানুষ মানসিক রোগকে “ভূতের আছর” বা “জিনের প্রভাব” বলে মনে করেন। এর ফলে, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার পরিবর্তে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, তাবিজ-কবজ, এবং ওঝা-বদ্যিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
  2. “অভিশাপ বা পাপের ফল”: অনেক সমাজে মানসিক সমস্যা ভিন্নভাবে দেখা হয়, যেমন এটি পাপের ফল বা পূর্বজন্মের অভিশাপ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। এই ধরণের চিন্তাভাবনা মানুষকে চিকিৎসার পথে না নিয়ে গিয়ে অন্ধকারে ফেলে রাখে।
  3. “শারীরিক অসুস্থতা নয়”: মানসিক সমস্যাকে শারীরিক অসুস্থতার চেয়ে কম গুরুতর মনে করা হয়। অনেকেই মনে করেন, মানসিক রোগীরা আসলে “খারাপ” বা “অদ্ভুত” আচরণ করছে, যা শুধুমাত্র তাদের ইচ্ছাশক্তির অভাবের কারণে। এই ধরনের ধারণা সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করে এবং সঠিক চিকিৎসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে।
  4. “মেডিকেশন বা থেরাপি অপ্রয়োজনীয়”: অনেক মানুষ মনে করে যে মানসিক সমস্যার জন্য ওষুধ বা থেরাপি প্রয়োজন নেই। বরং তারা প্রাকৃতিক বা ধর্মীয় পন্থায় সমাধানের চেষ্টা করে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যকর হয় না।

কুসংস্কারের প্রভাব

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কুসংস্কারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এটি সমস্যার সমাধানের পথকে বন্ধ করে দেয়। একজন ব্যক্তি যখন মানসিক সমস্যায় ভোগেন, তাকে চিকিৎসকের কাছে না নিয়ে গিয়ে কুসংস্কারের মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে গেলে সময়মতো চিকিৎসা হয় না। এর ফলে, অনেকেই সমস্যার গভীরতায় আটকে পড়েন এবং সমস্যাগুলো জটিল হয়ে ওঠে।

এছাড়াও, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কুসংস্কার রোগীদের সামাজিক জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেকেই মানসিক রোগীদের ত্যাগ করেন বা তাদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখেন, কারণ তারা মনে করেন যে এসব রোগ সংক্রমণযোগ্য বা খারাপ প্রভাব ফেলবে।

raju akon youtube channel subscribtion

কুসংস্কার থেকে মুক্তির উপায়

  1. সচেতনতা বৃদ্ধি: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সমাজে মানুষকে মানসিক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে হবে এবং কুসংস্কার দূর করার জন্য প্রচারাভিযান চালাতে হবে।
  2. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: শিক্ষাব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশিক্ষণ এবং আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। স্কুল এবং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে সচেতন করা গুরুত্বপূর্ণ।
  3. সামাজিক সমর্থন: মানসিক রোগীদের সামাজিক সহায়তা দেওয়া এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া প্রয়োজন। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের উচিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুক্তভোগী ব্যক্তির পাশে থাকা এবং তাদের চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করা।
  4. গবেষণা ও তথ্য প্রচার: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আরও গবেষণা করা এবং সেই তথ্যগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তথ্যের অভাবে মানুষ কুসংস্কারপ্রবণ হয়ে পড়ে, তাই সঠিক তথ্য প্রদান এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কুসংস্কার দূর করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা সঠিক শিক্ষা, সচেতনতা, এবং সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব। মানুষকে বুঝতে হবে যে মানসিক রোগও শারীরিক রোগের মতোই সাধারণ এবং এটি চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করা যায়। সমাজের প্রতিটি স্তরে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধানের পথ খুলে দিতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top