নবজাতকের যত্নে একটি বৈপ্লবিক পদ্ধতি হলো ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (Kangaroo Mother Care বা KMC), যা বিশেষত প্রিম্যাচিউর বা কম ওজনের নবজাতকের জন্য কার্যকর। এটি একটি সহজ, সহজলভ্য এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উপায়, যা নবজাতক মৃত্যুর হার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারে মায়ের বুকে সরাসরি নবজাতককে রেখে উষ্ণতা, সুরক্ষা এবং খাওয়ানোর সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। এতে শিশুর স্বাস্থ্যগত উন্নতি ঘটে এবং মৃত্যুর ঝুঁকি কমে।
এই ব্লগে আমরা ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো এবং এটি কীভাবে নবজাতক মৃত্যুর হার কমাতে সহায়ক, তা ব্যাখ্যা করবো।
১. ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার কি?
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার একটি সহজ পদ্ধতি যেখানে মায়ের বুকে সরাসরি শিশুকে রাখা হয়। এর মাধ্যমে শিশুকে ত্বকের উষ্ণতা ও স্নেহের স্পর্শ প্রদান করা হয়, যা শিশুর শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। মায়ের ত্বকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে শিশুর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয় এবং শিশুর হৃদস্পন্দন স্থিতিশীল থাকে।
২. ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারের উপকারিতা
২.১. শিশুর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
প্রিম্যাচিউর বা কম ওজনের শিশুর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে মায়ের উষ্ণতা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতিতে মায়ের ত্বক শিশুর শরীরকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখে, যা শিশুর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
২.২. শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন নিয়মিত থাকে
মায়ের বুকের উষ্ণতায় শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। এতে শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমে এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার হ্রাস পায়।
২.৩. মায়ের দুধের প্রবাহ বৃদ্ধি
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতিতে শিশু মায়ের দুধ সহজে গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে শিশুর পুষ্টির অভাব পূরণ হয় এবং দুধের প্রবাহ বেড়ে যায়, যা নবজাতকের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
২.৪. মানসিক উন্নতি ও নিরাপত্তাবোধ
মায়ের বুকে শিশুকে রাখার মাধ্যমে শিশুর সঙ্গে মায়ের মানসিক বন্ধন শক্তিশালী হয়। এতে শিশু নিজেকে নিরাপদ অনুভব করে এবং মানসিক উন্নতি ঘটে।
২.৫. ইনফেকশনের ঝুঁকি কমে
মায়ের বুকে থাকার ফলে শিশুর শরীরে ভালো ব্যাকটেরিয়া পৌঁছায়, যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এতে ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
৩. ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি কিভাবে কাজ করে?
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করা খুবই সহজ। এখানে কিছু ধাপ উল্লেখ করা হলো:
৩.১. মায়ের ত্বকের সঙ্গে সরাসরি শিশুর স্পর্শ
মায়ের বুকের সঙ্গে শিশুর সরাসরি ত্বকের স্পর্শ রাখতে হবে। শিশুকে এমনভাবে রাখা হয় যাতে তার মাথা মায়ের বুকের কাছে থাকে।
৩.২. নিয়মিত সময়ের জন্য রাখা
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার প্রতিদিন কমপক্ষে কয়েক ঘণ্টা ধরে নিয়মিত করতে হয়। এটি শিশুর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সহায়ক।
৩.৩. মায়ের স্নেহ ও সুরক্ষা
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারের সময় মায়ের ভালোবাসা ও স্নেহ শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মায়ের কণ্ঠস্বর এবং হৃদস্পন্দন শিশুর জন্য প্রশান্তি দেয়।
৪. ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারের সফলতা
বিশ্বের অনেক দেশেই ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করে নবজাতকের স্বাস্থ্য উন্নত করা হয়েছে। প্রিম্যাচিউর এবং কম ওজনের নবজাতকের জন্য এটি বিশেষভাবে কার্যকর, এবং এ পদ্ধতির মাধ্যমে শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে অত্যাধুনিক নবজাতক যত্নের ব্যবস্থা সহজলভ্য নয়, সেখানে এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
৫. কাদের জন্য ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার উপযোগী?
৫.১. প্রিম্যাচিউর শিশু
জন্মের সময় যেসব শিশু ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেয় এবং কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাদের জন্য ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার খুবই উপকারী।
৫.২. কম ওজনের শিশু
যেসব শিশু জন্মের সময় ২.৫ কেজির কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাদের জন্য এই পদ্ধতি কার্যকর।
৫.৩. উন্নয়নশীল দেশের নবজাতক
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে নবজাতক যত্নের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সহজলভ্য নয়, সেখানে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার একটি সহজ এবং ব্যয়বহুল পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
উপসংহার
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার নবজাতকের জীবন রক্ষার একটি সহজ, সাশ্রয়ী এবং কার্যকর উপায়। এটি শুধুমাত্র শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য নয়, মানসিক এবং পারিবারিক বন্ধন তৈরিতেও সহায়ক। প্রিম্যাচিউর এবং কম ওজনের শিশুদের জন্য এই পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নবজাতক মৃত্যুর হার কমাতে এটি বিশ্বব্যাপী একটি প্রমাণিত এবং গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি।