সৌদি আরব, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী শ্রমিকরা কাজের জন্য আসেন, সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে শ্রমিকদের বেতন এবং পরিচয় সম্পর্কিত সমস্যা, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সৌদি আরবের শ্রমিকদের মধ্যে যারা নিম্নমানের কাজ করেন, বিশেষত যারা কম বেতনে কাজ করেন, তারা প্রায়শই বেতন পরিশোধ, কাজের পরিবেশ এবং সামাজিক অবস্থা নিয়ে মানসিক চাপের সম্মুখীন হন। এই সমস্যা একদিকে যেমন শারীরিকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, অন্যদিকে মানসিকভাবে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। চলুন, জানি সৌদি আরবে বেতন-পরিচয়ের সমস্যা কীভাবে শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এর সমাধানে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
১. বেতন পরিশোধের সমস্যা এবং মানসিক চাপ
সৌদি আরবে শ্রমিকদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা হলো বেতন পরিশোধের সময়সীমা মেনে চলা না হওয়া। অনেক শ্রমিক অভিযোগ করেন যে, তাদের বেতন সময়মতো দেয়া হয় না বা কাজের প্রতিদান পুরোপুরি প্রদান করা হয় না। এই ধরনের সমস্যা শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। বেতন পরিশোধে দেরি হওয়ার কারণে তাদের আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে, যা মানসিক চাপ এবং বিষণ্ণতার কারণ হতে পারে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শ্রমিক নিয়মিত বেতন পান না বা বেতন কম পান, তাদের মধ্যে উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার প্রবণতা বেশি থাকে। যখন মানুষ আর্থিকভাবে নিরাপদ না থাকে, তখন তারা নিজের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করে এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চাপ আসে।
২. পরিচয় এবং সম্মানজনক কাজের অভাব
সৌদি আরবে অনেক অভিবাসী শ্রমিককে তাদের পরিচয়ের জন্য যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। অনেক সময়, তারা যে ধরনের কাজ করেন, সেটি তাদের সমাজে সম্মানজনক হিসেবে দেখা হয় না। এই সামাজিক অবমূল্যায়ন তাদের মধ্যে একাকীত্ব, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং হতাশার সৃষ্টি করতে পারে। পরিচয়ের অভাব এবং সামাজিক মর্যাদার জন্য মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া, যখন শ্রমিকরা তাদের কাজের প্রতি মূল্যায়ন এবং সম্মান না পান, তারা নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠা হারাতে পারেন। এটি তাদের মানসিক সুস্থতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ এবং হতাশা তাদের জীবনে আরও বেশি অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
৩. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্ব
বেতন এবং পরিচয় সম্পর্কিত সমস্যা অনেক শ্রমিকের মধ্যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্ব সৃষ্টি করতে পারে। অনেক অভিবাসী শ্রমিক, যারা পরিবার থেকে দূরে রয়েছেন, তাদের জন্য সামাজিকভাবে সংযুক্ত হওয়ার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক বাধা। যখন তাদের আর্থিক সমস্যার পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কের অভাবও থাকে, তখন তারা একাকীত্ব অনুভব করেন। এই একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার কারণে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে ক্ষতি হতে পারে।
অনেক শ্রমিক জানেন না, তাদের কাছ থেকে সহায়তা নেয়ার সুযোগ কোথায় এবং তারা তাদের অনুভূতি কীভাবে শেয়ার করবেন। এই কারণে, তারা আরও বেশি হতাশ ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, যা মানসিক চাপ এবং অবসাদ বাড়াতে সাহায্য করে।
৪. স্বাস্থ্য সেবা এবং সহায়তার অভাব
সৌদি আরবে বেশিরভাগ শ্রমিকদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সহজলভ্য নয়। বিশেষত, যারা নিম্নমানের কাজ করেন, তাদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা সীমিত এবং উচ্চ খরচের কারণে অনেক শ্রমিক এতে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সহায়তা না পেলে, তাদের সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
যেহেতু শ্রমিকরা অধিকাংশ সময় সঠিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পান না, তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ এবং উদ্বেগ আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে, যার ফলস্বরূপ তারা সামাজিক এবং শারীরিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
৫. কর্মঘণ্টার দীর্ঘতা এবং কাজের পরিবেশ
কর্মঘণ্টার দীর্ঘতা এবং কঠোর কাজের পরিবেশও শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। সৌদি আরবে অনেক শ্রমিকের দৈনিক কাজের সময় আট থেকে দশ ঘণ্টা বা তার বেশি হতে পারে। দীর্ঘ সময় কাজ করার ফলে তাদের মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং সামাজিক জীবনে অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকলে, একাকীত্ব, হতাশা এবং মানসিক চাপ বেড়ে যায়।
এছাড়া, যদি কাজের পরিবেশ নিরাপদ না হয় বা শারীরিকভাবে অত্যধিক পরিশ্রম হয়, তবে তা তাদের শারীরিক চাপের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
সমাধান: মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ
- বেতন পরিশোধের সঠিক ব্যবস্থা: শ্রমিকদের জন্য একটি স্বচ্ছ এবং সঠিক বেতন পরিশোধ ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত। নিয়মিত বেতন পাওয়ার মাধ্যমে শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
- মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: সৌদিতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়ানো এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শ্রমিকদের মানসিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- সামাজিক সংযোগ: শ্রমিকদের জন্য সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করা উচিত, যাতে তারা একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার অভাব কাটাতে পারে। সহকর্মী এবং কমিউনিটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
- পরিচয়ের এবং মর্যাদার উন্নতি: শ্রমিকদের জন্য সম্মানজনক কাজ এবং মর্যাদা নিশ্চিত করা উচিত। কর্মক্ষেত্রে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং প্রশংসা প্রদান তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সাহায্য করবে।
- শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা: শ্রমিকদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সুস্থ জীবনধারার প্রচার করা উচিত।
সৌদি আরবে শ্রমিকদের বেতন এবং পরিচয় সম্পর্কিত সমস্যাগুলি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে, সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তাদের মানসিক শক্তি এবং সুস্থতা উন্নত করা সম্ভব। বেতন পরিশোধের নিয়মিত ব্যবস্থা, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, সামাজিক সম্পর্ক এবং পরিচয়ের প্রতি শ্রদ্ধা তাদের মানসিক শান্তি ও শক্তি বাড়াতে সহায়তা করবে।
অনলাইনে কাউন্সেলিং সেবার জন্য আমার ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করুন: rajuakon.com/contact
