করোনাকালীন সময়টি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। যখন পুরো বিশ্ব মহামারির ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত, তখন শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যও এক গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। স্কুল বন্ধ, সামাজিক দূরত্ব, এবং বাড়িতে বন্দী থাকা শিশুদের মানসিক ও আবেগীয় বিকাশের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। সঠিক সময়ে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া এবং তাদেরকে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত রাখার জন্য সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
করোনাকালে শিশুর মানসিক চ্যালেঞ্জ:
এই মহামারিকালে শিশুরা তাদের দৈনন্দিন রুটিন হারিয়েছে, যেটি তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। স্কুলের বন্ধ হওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না করা, এবং ঘরে বন্দী থাকায় শিশুরা একঘেয়েমি এবং হতাশায় ভুগছে। পরিবারের মধ্যে আর্থিক অনিশ্চয়তা বা অসুস্থতা থেকেও শিশুরা মানসিকভাবে চাপের মধ্যে পড়তে পারে।
মানসিক চ্যালেঞ্জের কিছু সাধারণ লক্ষণ:
- উদ্বেগ বা অতিরিক্ত ভয়।
- একাকীত্ব বা বিষণ্নতা।
- ঘুমের সমস্যা।
- আচরণগত পরিবর্তন, যেমন অতিরিক্ত রাগ বা অস্থিরতা।
- আত্মবিশ্বাসের অভাব।
- পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাওয়া।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করার উপায়:
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এই পদক্ষেপগুলো শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ এবং মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
১. নিয়মিত রুটিন:
শিশুদের দৈনন্দিন রুটিন বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি তাদেরকে একটি স্থিতিশীলতা প্রদান করে এবং জীবনের স্বাভাবিক ধারা বজায় রাখতে সহায়ক হয়। রুটিনে পর্যাপ্ত সময় ঘুম, খেলা, পড়াশোনা এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
২. শিশুর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা:
শিশুরা যখন মানসিক চাপে থাকে তখন তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা জরুরি। শিশুরা কী অনুভব করছে এবং তাদের সমস্যাগুলো কী, তা শোনার জন্য সময় দেওয়া উচিত। এতে তারা নিজেদের চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে এবং মানসিক শান্তি পায়।
৩. সৃজনশীল কার্যকলাপে নিয়োজিত রাখা:
শিশুদের মানসিক চাপ কমাতে এবং তাদের মানসিক বিকাশের জন্য সৃজনশীল কার্যকলাপে নিয়োজিত রাখা জরুরি। যেমন আঁকা, গঠনমূলক খেলাধুলা, পাজল সমাধান করা বা কোনো নতুন শখে আগ্রহী করে তোলা। এসব কার্যকলাপ তাদের মনোযোগ ধরে রাখতে এবং মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক।
৪. শারীরিক সক্রিয়তা:
শিশুদের শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি। বাড়ির মধ্যে বিভিন্ন খেলাধুলা, ব্যায়াম, বা নাচের মাধ্যমে তারা শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকতে পারে। এটি তাদের মানসিক চাপ কমাতে এবং মনোযোগের উন্নতিতে সহায়ক।
৫. সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখা:
যদিও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে, তবুও ভার্চুয়াল মাধ্যমে শিশুদের বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন। এটি তাদের একাকীত্ব কমাতে এবং সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পিতামাতার ভূমিকা:
করোনাকালে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় পিতামাতার ভূমিকা অপরিসীম। শিশুরা কীভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করা এবং তাদের মানসিক সমর্থন প্রদান করা পিতামাতার দায়িত্ব।
১. সমর্থন এবং ভালোবাসা:
শিশুদের মানসিক চাপ কমানোর জন্য পিতামাতার সমর্থন এবং ভালোবাসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কঠিন সময়েও শিশুরা যেন নিজেদের সুরক্ষিত এবং ভালোবাসায় আবদ্ধ অনুভব করে তা নিশ্চিত করা উচিত।
২. পেশাদার সহায়তা নেওয়া:
যদি কোনো শিশু মানসিক সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে থাকে, তবে পেশাদার সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সিলর থেকে পরামর্শ নেওয়া হলে শিশুর মানসিক সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।
করোনাকালে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় পিতামাতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সবারই দায়িত্ব রয়েছে। শিশুদের মানসিক চাহিদা মেটানোর জন্য সচেতন থাকা এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। শিশুর মানসিক সুস্থতা তাদের সামগ্রিক বিকাশের মূল ভিত্তি, এবং এ বিষয়ে কোনো অবহেলা করা উচিত নয়।