দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকা মানসিকভাবে কতটা ক্ষতিকর?

প্রবাসী জীবনে অনেকেই দীর্ঘ সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। সৌদি আরব, দুবাই, কুয়েত, মালয়েশিয়া বা অন্যান্য দেশে কাজের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশি অনেক সময় তাদের পরিবারের কাছ থেকে বহু দূরে থাকেন। পরিবার ছাড়িয়ে একা থাকার এই অভিজ্ঞতা মানসিক স্বাস্থ্য এবং শারীরিক সুস্থতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও প্রবাসী জীবন একদিকে অর্থনৈতিক সাফল্য এবং উন্নতি নিয়ে আসে, তবে দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকার মানসিক কষ্ট অনেক সময় অবশিষ্ট থাকতে পারে। আজকের ব্লগে আমরা আলোচনা করব দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকা মানসিকভাবে কতটা ক্ষতিকর এবং এই পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায়।

পরিবার থেকে দূরে থাকার মানসিক প্রভাব

১. একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি

দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকলে সবচেয়ে বড় প্রভাবটি হচ্ছে একাকীত্ব। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে শারীরিক এবং মানসিক সমর্থন না পাওয়ার কারণে প্রবাসী ব্যক্তি একাকী এবং বিচ্ছিন্ন অনুভব করতে পারেন। এই একাকীত্বের অনুভূতি একসময় মানসিকভাবে ক্লান্তি এবং হতাশার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

raju akon youtube channel subscribtion

মানসিক প্রভাব:
একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি দীর্ঘমেয়াদী হলে এটি অবসাদ, উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। পরিবারের কাছ থেকে সমর্থন না পাওয়ার কারণে তারা অনুভব করতে পারেন যে, তাদের পাশে কেউ নেই।

২. পারিবারিক সমস্যার জন্য উদ্বেগ

যেহেতু বেশিরভাগ প্রবাসী তাদের পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করতে যান, তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য, আর্থিক অবস্থা, বা অন্য যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা করতে হয়। এই উদ্বেগ তাদের মানসিক শান্তি নষ্ট করতে পারে, কারণ তারা জানেন না কীভাবে তাদের পরিবারের সমস্যাগুলো সমাধান করবেন।

মানসিক প্রভাব:
অর্থনৈতিক বা পারিবারিক সমস্যার উদ্বেগ প্রবাসী ব্যক্তির মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়, যা তাদের কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে অসুবিধা সৃষ্টি করে এবং এক ধরনের মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

৩. পরিচয় সংকট এবং সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব

যখন কেউ দীর্ঘদিন একটি ভিন্ন দেশে থাকে, তখন তার সংস্কৃতি এবং নিজস্ব পরিচয়ের প্রতি সন্দেহ এবং দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে শিশুরাও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের শিকার হতে পারে, যা তাদের মানসিক সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলে।

মানসিক প্রভাব:
পরিচয় সংকট এবং সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব শিশুর মধ্যে অস্থিরতা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি করতে পারে। বড়রা, বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন না, তাদের মধ্যে নিজেকে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে সমস্যা হতে পারে।

৪. শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি

প্রবাসীরা সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন, এবং পরিবারের কাছ থেকে কোনো সুরক্ষা বা মানসিক সমর্থন না পেলে শারীরিক এবং মানসিক ক্লান্তি বৃদ্ধি পেতে পারে। এই ক্লান্তি মানসিক অবসাদ এবং শারীরিক অসুস্থতার দিকে যেতে পারে, যা দৈনন্দিন জীবনকে কঠিন করে তোলে।

মানসিক প্রভাব:
শারীরিক ক্লান্তি এবং মানসিক চাপ একযোগে কাজ করে, যা ব্যক্তির সামগ্রিক সুস্থতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত কাজের চাপ, পরিবার থেকে দূরে থাকার অস্বস্তি এবং সঠিক সমর্থন না পাওয়ার কারণে অনেক প্রবাসী মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন।

দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকার মানসিক কষ্ট মোকাবিলার উপায়

১. নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখা

পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি কাটাতে সহায়ক হতে পারে। ভিডিও কল, ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে।

কীভাবে করবেন:

  • পরিবার বা প্রিয়জনদের সাথে নিয়মিত ভিডিও কল বা ফোনে কথা বলুন।
  • আপনার অনুভূতি এবং চিন্তা শেয়ার করুন, যাতে আপনি একাকী না অনুভব করেন।

২. নিজের শখ ও আগ্রহের প্রতি মনোযোগ দেওয়া

দীর্ঘদিন পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার কারণে যে একাকীত্ব সৃষ্টি হতে পারে, তা কাটাতে নিজের শখ এবং আগ্রহের প্রতি মনোযোগ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানসিক চাপ কমাতে এবং জীবনকে আনন্দময় করতে সহায়ক হতে পারে।

কীভাবে করবেন:

  • আপনার শখের কাজগুলো করুন, যেমন বই পড়া, ছবি আঁকা, গান শোনা, রান্না করা, ইত্যাদি।
  • কিছু সময় নিজের জন্য বের করুন এবং যা আপনাকে ভালো লাগে, তা করুন।

৩. সামাজিক সম্পর্ক গঠন এবং বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো

বন্ধু এবং সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে। অন্যদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং মনের অনুভূতি শেয়ার করা একাকীত্ব কমাতে সাহায্য করবে।

কীভাবে করবেন:

  • স্থানীয় কমিউনিটির অংশ হতে চেষ্টা করুন এবং বন্ধুর সাথে যোগাযোগ বাড়ান।
  • তাদের সঙ্গে সময় কাটান এবং একে অপরের অনুভূতি শেয়ার করুন।

৪. শারীরিক ব্যায়াম এবং যোগব্যায়াম

মানসিক চাপ কমানোর জন্য শারীরিক ব্যায়াম এবং যোগব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকরী। নিয়মিত ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং শরীরকে সুস্থ রাখে, যা অবসাদ এবং উদ্বেগ দূর করতে সহায়ক।

কীভাবে করবেন:

  • প্রতিদিন ৩০ মিনিট শারীরিক ব্যায়াম করুন।
  • যোগব্যায়াম বা ধ্যানের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন।

৫. পেশাদার সহায়তা গ্রহণ

যদি আপনি অনুভব করেন যে, মানসিক চাপ আপনার জীবনে প্রভাব ফেলছে এবং আপনি একাকী বা হতাশ বোধ করছেন, তবে একজন সাইকোলজিস্ট বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া উচিত। তারা আপনাকে মানসিক চাপ কমানোর কৌশল শিখাতে এবং আপনার সমস্যার সমাধান দিতে সাহায্য করতে পারেন।

কীভাবে করবেন:

  • স্থানীয় সাইকোলজিস্ট বা থেরাপিস্টের সাথে সেশন বুক করুন।
  • অনলাইন মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সাইকোলজিস্টের সাহায্য নিন।

দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকার মানসিক কষ্ট এবং একাকীত্ব এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হতে পারে, তবে এটি মোকাবিলা করা সম্ভব। পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ, সামাজিক সম্পর্ক গঠন, শারীরিক ব্যায়াম এবং পেশাদার সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে আপনি মানসিক চাপ কমাতে সক্ষম হবেন। প্রবাসী জীবনে মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা আপনাকে আরও সুস্থ এবং সুখী জীবন যাপন করতে সহায়তা করবে।

অনলাইনে কাউন্সেলিং সেবার জন্য আমার ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করুন: rajuakon.com/contact

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top