প্রবাসী জীবনে নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি, ভাষার বাধা এবং আর্থিক চাপের কারণে অনেক সময় দম্পতিদের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। বিশেষ করে বাঙালি দম্পতিরা যখন নিজেদের দেশের বাইরে চলে আসেন, তখন প্রাথমিকভাবে একটি নতুন জীবনের প্রতি আকর্ষণ থাকে, তবে দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। প্রবাসে বাঙালি দম্পতিদের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্বের কারণ এবং সেই সমস্যা সমাধানে কীভাবে সাহায্য করা যেতে পারে, এ বিষয়ে আলোচনা করব।
প্রবাসে বাঙালি দম্পতিদের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্বের কারণ
১. সংস্কৃতি এবং ভাষার পার্থক্য
প্রবাসে আসলে দম্পতিদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সম্পর্কের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি হতে পারে। বিদেশে বসবাস করার সময় একে অপরের সংস্কৃতি, ভাষা এবং সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে অসঙ্গতি দেখা দিতে পারে, যা সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে। অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের শিথিলতার কারণে, তারা একে অপরের প্রতি উদাসীন হতে পারেন।
২. অর্থনৈতিক চাপ
প্রবাসী জীবনে অর্থনৈতিক চাপ অনেক সময় সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে। পরিবারের ব্যয়, কাজের চাপ এবং অর্থ উপার্জন নিয়ে উদ্বেগ দম্পতিদের মধ্যে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে, কারণ একে অপরের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার জায়গা কমে যায়।
৩. কর্মজীবনের চাপ এবং সময়ের অভাব
প্রবাসে জীবিকা নির্বাহের জন্য বেশিরভাগ সময়ই দম্পতিদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, এবং এটি সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারে। একে অপরের জন্য সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে সম্পর্কের মধ্যে যোগাযোগ এবং ঘনিষ্ঠতার অভাব দেখা দেয়। কর্মস্থলের চাপ এবং জীবনযাত্রার তাড়াহুড়ির মধ্যে সম্পর্কের যত্ন নেওয়া কঠিন হয়ে যায়।
৪. একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা
বাঙালি দম্পতিরা প্রবাসে একে অপরের কাছ থেকে দূরে থাকেন, এবং পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবও তাদের মধ্যে একাকীত্ব সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যারা একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে বাইরে থাকেন, তাদের মধ্যে একাকীত্ব এবং সম্পর্কের প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে।
৫. শিশুদের যত্ন এবং পারিবারিক দায়িত্ব
প্রবাসে শিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালন, স্কুল, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য পারিবারিক সমস্যা নিয়ে দম্পতির মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে। কখনও কখনও এই চাপ সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে, এবং তারা একে অপরের প্রতি আগ্রহ বা সহানুভূতি কমে যেতে পারে।
সম্পর্কের দূরত্ব কমানোর জন্য ৫টি সমাধান
১. যোগাযোগ বাড়ানো
প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একে অপরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখা। প্রবাসে থাকা অবস্থায় নিয়মিত ফোন কল, ভিডিও চ্যাট বা মেসেজের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্পর্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। দিনে অন্তত একবার একে অপরের অনুভূতি ও চিন্তা শেয়ার করা সম্পর্কের মানসিক দূরত্ব কমাতে পারে।
২. পরিবারের প্রতি মনোযোগ দেওয়া
প্রবাসে থাকার ফলে পরিবারের সদস্যদের প্রতি একে অপরের মনোযোগ কমে যায়। কিন্তু সম্পর্কের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একে অপরের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষত, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একে অপরের ছোট ছোট বিষয় নিয়ে কথা বলা, বিশেষ দিনগুলিতে একে অপরকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সম্পর্কের দূরত্ব কমাতে সাহায্য করবে।
৩. বিশেষ সময় কাটানো
কঠোর কাজের চাপ এবং পরিবার নিয়ে দায়িত্ব পালন করার কারণে অনেক সময় একে অপরের জন্য সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সম্পর্কের প্রতি গুরুত্ব দিতে হলে, একে অপরের জন্য সময় বের করা প্রয়োজন। সপ্তাহে একদিন বা মাসে কিছু সময় একসাথে কাটানো, বাইরে যেতে অথবা কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য একসঙ্গে সময় কাটানো সম্পর্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এবং ভালবাসা বাড়াতে সাহায্য করবে।
৪. পারস্পরিক সহানুভূতি ও সমর্থন
প্রবাসে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি এবং মানসিক সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে সম্পর্কের দূরত্ব কমানো সম্ভব। প্রবাসী জীবনে একজনের মানসিক চাপ অন্যজনের জন্য বোঝা হতে পারে। কাজের চাপ, একাকীত্ব, অথবা কোনো শারীরিক অসুস্থতা—এইসব সমস্যা একে অপরের মধ্যে আলোচনা করে সমাধান করা প্রয়োজন। একে অপরকে সঠিকভাবে শোনা এবং সহানুভূতির মাধ্যমে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়।
৫. পারিবারিক এবং সামাজিক সমর্থন বাড়ানো
একাকীত্ব বা বিচ্ছিন্নতা অনুভব করলে, একে অপরকে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে সমর্থন দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটিতে যুক্ত হওয়া, নতুন বন্ধু তৈরি করা এবং পরিবার থেকে নিয়মিত সহায়তা নেওয়া সম্পর্কের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এতে একে অপরের প্রতি নির্ভরতা এবং সম্পর্কের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।
পেশাদার সহায়তা
কখনও কখনও সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব এত বেড়ে যায় যে, নিজে সমাধান খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায়, একজন পেশাদার কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টের সাহায্য নেওয়া উপকারী হতে পারে। একজন পেশাদার পরামর্শদাতা সম্পর্কের সমস্যাগুলি সমাধান করতে সাহায্য করতে পারেন এবং আপনাকে আরও ভালোভাবে একে অপরকে বোঝার এবং সম্পর্কের সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য গাইড করতে পারেন।
আমি রেজু আকন, একজন অভিজ্ঞ কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, আপনাকে সুরক্ষিত এবং গোপনীয় পরিবেশে সাহায্য প্রদান করতে প্রস্তুত। আপনি এখানে ক্লিক করুন এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
প্রবাসে বাঙালি দম্পতিদের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব একটি সাধারণ সমস্যা, তবে এটি সমাধান করা সম্ভব। নিয়মিত যোগাযোগ, পারস্পরিক সহানুভূতি, একে অপরের প্রতি মনোযোগ এবং সঠিক মানসিক সমর্থন সম্পর্কের শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। যখন সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়, তখন তাকে মোকাবিলা করতে সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।