শিশুর বিকাশ ধাপে ধাপে ঘটে এবং প্রতিটি শিশু নিজস্ব গতিতে বিকশিত হয়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে, শিশুদের বিকাশে বিলম্ব হতে পারে, যা সাধারণত “বিলম্বিত বিকাশ” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে, অটিজম একটি নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার যা শিশুর সামাজিক, ভাষাগত, এবং আচরণগত বিকাশে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। বিলম্বিত বিকাশ এবং অটিজমের মধ্যে পার্থক্য বোঝা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হতে পারে। তবে দ্রুত নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১. বিলম্বিত বিকাশ কি?
বিলম্বিত বিকাশ হলো শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের ধাপগুলোতে পিছিয়ে থাকা। এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতে পারে, যেমন:
- ভাষাগত বিকাশে বিলম্ব: শিশু সময়মতো কথা বলতে শুরু না করা বা যোগাযোগে সমস্যা।
- মোটর স্কিল বিকাশে বিলম্ব: শিশু সময়মতো হাঁটতে বা বসতে না পারা।
- সামাজিক বিকাশে বিলম্ব: অন্য শিশুদের সাথে খেলার আগ্রহ না থাকা।
- মানসিক বিকাশে বিলম্ব: সমস্যা সমাধানে বা চিন্তাভাবনায় সমস্যা।
২. অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD):
অটিজম একটি নিউরোডেভেলপমেন্টাল সমস্যা যা শিশুর সামাজিক যোগাযোগ, আচরণ এবং অন্যান্য বিকাশের ক্ষেত্রগুলোকে প্রভাবিত করে। অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় সমস্যা অনুভব করে, এবং কিছু নির্দিষ্ট আচরণ বা আগ্রহে আটকে থাকে। কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- চোখের যোগাযোগ এড়ানো।
- ভাষাগত বা সামাজিক যোগাযোগে সমস্যা।
- পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ, যেমন একই কাজ বারবার করা।
- দৈনন্দিন রুটিনে পরিবর্তন হলে অস্বস্তি অনুভব করা।
৩. বিলম্বিত বিকাশ এবং অটিজমের মধ্যে পার্থক্য:
- সামাজিক আচরণ: বিলম্বিত বিকাশের শিশুদের সাধারণত সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় সমস্যা কম থাকে, তবে অটিজম আক্রান্ত শিশুরা অন্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে এবং আবেগ বুঝতে সমস্যার সম্মুখীন হয়।
- পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ: অটিজম আক্রান্ত শিশুরা পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ বেশি করে, যা বিলম্বিত বিকাশের শিশুদের মধ্যে কম দেখা যায়।
- চোখের যোগাযোগ: অটিজম শিশুদের চোখের যোগাযোগ এড়ানোর প্রবণতা থাকে, যা সাধারণ বিকাশগত বিলম্বের শিশুদের মধ্যে ততটা দেখা যায় না।
- আগ্রহের সীমাবদ্ধতা: অটিজম শিশুরা অনেক সময় সীমিত বিষয়ে অতিরিক্ত আগ্রহী থাকে, যেমন কোনো নির্দিষ্ট খেলনা বা বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় করা।
৪. বিলম্বিত বিকাশ এবং অটিজমের কারণ:
বিলম্বিত বিকাশ এবং অটিজম উভয়েরই কারণ হতে পারে জিনগত বা পরিবেশগত প্রভাব। কিছু প্রধান কারণ হলো:
- জিনগত ফ্যাক্টর: কিছু শিশুর বিকাশে জিনগত সমস্যা থাকলে বিকাশে বিলম্ব হতে পারে, একইভাবে অটিজমের ক্ষেত্রেও জিনগত ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ।
- গর্ভাবস্থার সমস্যা: মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে শিশুর বিকাশে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
- পরিবেশগত ফ্যাক্টর: জন্মের পর শিশুর যত্নে অবহেলা বা অপর্যাপ্ত যত্নও বিকাশে বিলম্ব ঘটাতে পারে।
৫. চিকিৎসা এবং থেরাপি:
- প্রারম্ভিক হস্তক্ষেপ: অটিজম বা বিলম্বিত বিকাশ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রারম্ভিক থেরাপি এবং সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। প্রারম্ভিক হস্তক্ষেপ শিশুর বিকাশের গতি বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
- স্পিচ থেরাপি: ভাষাগত বিকাশে সমস্যা থাকলে স্পিচ থেরাপি অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে।
- অকুপেশনাল থেরাপি: মোটর স্কিল উন্নয়নে অকুপেশনাল থেরাপি সহায়ক।
- বিহেভিয়ারাল থেরাপি: অটিজম আক্রান্ত শিশুদের জন্য ABA (Applied Behavior Analysis) থেরাপি ব্যবহার করে আচরণগত উন্নয়ন সম্ভব।
৬. কখন ডাক্তার দেখাবেন?
যদি আপনার সন্তানের বিকাশ নিয়ে আপনি চিন্তিত হন, তবে একজন শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কিছু লক্ষণ দেখে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
- ১২ মাসের মধ্যে চোখের যোগাযোগ না করা।
- ১৬ মাস বয়সে কোনো শব্দ বা শব্দের মাধ্যমে যোগাযোগ না করা।
- ২৪ মাস বয়সে কোনো কথা না বলা।
- অন্যান্য শিশুদের সাথে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় সমস্যা।
উপসংহার
বিলম্বিত বিকাশ এবং অটিজম উভয়েরই নির্ণয় এবং চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বা বিকাশের বিলম্ব যাই হোক না কেন, প্রারম্ভিক পর্যায়ে নির্ণয় এবং থেরাপি শিশুর ভবিষ্যত উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। শিশুর লক্ষণগুলো দ্রুত শনাক্ত করে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া পরিবারকে শিশুর জন্য সর্বোত্তম ফলাফল এনে দিতে পারে।