সিলেক্টিভ মিউটিজম একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বা নির্দিষ্ট ব্যক্তির সাথে কথা বলতে অক্ষম হন, যদিও অন্য পরিস্থিতিতে বা অন্য ব্যক্তির সাথে তারা স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে সক্ষম হন। এই অবস্থা সাধারণত শিশুদের মধ্যে দেখা যায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও থাকতে পারে। সিলেক্টিভ মিউটিজমের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, এবং সিবিটি (কগনিটিভ-বিহেভিয়ারাল থেরাপি) এর অন্যতম প্রধান থেরাপি।
সিবিটি কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে?
সিবিটি একটি মনোবিদ্যাগত পদ্ধতি, যা ব্যক্তির চিন্তাধারা, বিশ্বাস, এবং আচরণের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে। এই থেরাপির মাধ্যমে নেতিবাচক চিন্তা ও বিশ্বাসগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোকে পরিবর্তন করা হয়, যাতে তা আচরণেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। সিলেক্টিভ মিউটিজমের ক্ষেত্রে, সিবিটি ব্যক্তির ভীতি ও উদ্বেগ কমাতে এবং কথা বলার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
সিলেক্টিভ মিউটিজমের জন্য সিবিটি থেরাপির কিছু কার্যকর টেকনিক
১. এক্সপোজার থেরাপি
সিলেক্টিভ মিউটিজমের চিকিৎসায় এক্সপোজার থেরাপি অত্যন্ত কার্যকর। এতে ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি করা হয় যেখানে তারা কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন। এটি ধাপে ধাপে করা হয়, যেমন প্রথমে পরিচিত বা আরামদায়ক পরিবেশে কথা বলার চেষ্টা করা, তারপর ধীরে ধীরে কম পরিচিত পরিবেশে নিজেকে প্রকাশ করা। এটি একটি সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া হওয়া উচিত, যাতে ব্যক্তি অস্বস্তি অনুভব না করেন।
২. সেলফ মনিটরিং এবং জার্নালিং
সেলফ মনিটরিং হলো নিজের আচরণ, চিন্তাধারা, এবং আবেগগুলোর রেকর্ড রাখা। জার্নালিংয়ের মাধ্যমে প্রতিদিনের পরিস্থিতিতে কীভাবে সিলেক্টিভ মিউটিজমের লক্ষণগুলো দেখা দেয় তা লিখে রাখা যায়। এটি ব্যক্তি ও থেরাপিস্ট উভয়ের জন্যই খুবই উপকারী, কারণ এর মাধ্যমে সমস্যার গভীরতা এবং উন্নতির হার নির্ধারণ করা সহজ হয়।
৩. রিলাক্সেশন টেকনিক
রিলাক্সেশন টেকনিক, যেমন গভীর শ্বাস গ্রহণ, ধ্যান, বা মাইন্ডফুলনেস, সিলেক্টিভ মিউটিজমের সাথে সম্পর্কিত উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। এই টেকনিকগুলোর মাধ্যমে ব্যক্তি মানসিক চাপ কমাতে পারেন এবং পরিস্থিতি সামলানোর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারেন। নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে এটি একটি অভ্যাসে পরিণত হতে পারে, যা সংকটময় মুহূর্তে কথা বলতে সহায়ক হতে পারে।
৪. চিন্তার পুনর্গঠন (Cognitive Restructuring)
চিন্তার পুনর্গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিবিটি টেকনিক, যা নেতিবাচক চিন্তা এবং ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। সিলেক্টিভ মিউটিজমের ক্ষেত্রে, ব্যক্তি প্রায়ই নেতিবাচক চিন্তাগুলো দ্বারা প্রভাবিত হন, যেমন “আমি কথা বললে সবাই আমাকে বিচার করবে।” এই টেকনিকের মাধ্যমে, এই ধরনের চিন্তাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা এবং ইতিবাচক বিকল্প চিন্তাগুলো গড়ে তোলা হয়।
৫. সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি (Social Skills Training)
সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি সিলেক্টিভ মিউটিজমের জন্য একটি কার্যকরী টেকনিক। এতে ব্যক্তি বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতিতে কীভাবে আচরণ করবেন তা শিখতে পারেন। এই প্রশিক্ষণটি ব্যক্তিকে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সাহায্য করে। বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতিতে কীভাবে কথা বলতে হবে, কীভাবে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে—এসব বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
নিজে থেকেই সিবিটি থেরাপি প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ এবং পরামর্শ
সিবিটি টেকনিকগুলো নিজের উপরে প্রয়োগ করার সময় কিছু চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। প্রথমত, নিজের চিন্তা এবং আচরণ পর্যবেক্ষণ করা এবং তা পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা কঠিন হতে পারে। দ্বিতীয়ত, সঠিকভাবে এক্সপোজার থেরাপি পরিচালনা করা প্রায়ই কঠিন হতে পারে, কারণ এটি ধাপে ধাপে এবং সঠিকভাবে করতে হয়।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য কিছু পরামর্শ:
- ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করুন: বড় সমস্যাকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিন এবং প্রতিটি অংশে কাজ করুন।
- সময় দিন: ধৈর্য সহকারে প্রতিটি টেকনিক প্রয়োগ করুন এবং দ্রুত ফলাফল আশা করবেন না।
- সহায়ক গ্রুপের সাথে যুক্ত হন: যারা একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তাদের সাথে কথা বলুন এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন।
উপসংহার
সিলেক্টিভ মিউটিজমের জন্য সিবিটি থেরাপি অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়। নিজের উপরে এই টেকনিকগুলো প্রয়োগ করার মাধ্যমে ব্যক্তি ধীরে ধীরে নিজের ভীতি ও উদ্বেগ কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। তবে, নিজে থেকেই সিবিটি প্রয়োগ করার আগে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, যাতে থেরাপির সঠিক প্রয়োগ এবং ফলাফল নিশ্চিত করা যায়।