মুখে লালা উৎপাদন একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যা খাবার হজম ও মুখের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে যদি অতিরিক্ত লালা (Hypersalivation) তৈরি হয়, তাহলে এটি অস্বস্তিকর হতে পারে এবং কোনো অন্তর্নিহিত শারীরিক সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। অনেকেই এই সমস্যায় ভুগে থাকেন, বিশেষ করে ঘুমের সময় বা কথা বলার সময়। আজকের ব্লগে আমরা মুখে অতিরিক্ত লালা আসার কারণ, সম্ভাব্য সমস্যা ও কার্যকর প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
মুখে অতিরিক্ত লালা আসার কারণ
অতিরিক্ত লালা উৎপাদনের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে কিছু সাধারণ ও কিছু জটিল স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে।
১. মুখের ভেতরের সংক্রমণ বা প্রদাহ
✅ দাঁতের সমস্যা, গিংগিভাইটিস বা মুখের ঘা থাকলে লালার প্রবাহ বেড়ে যেতে পারে।
✅ টনসিলের ইনফেকশন বা গলার প্রদাহ থাকলেও অতিরিক্ত লালা আসতে পারে।
২. এসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যা
✅ গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) বা অ্যাসিড রিফ্লাক্স হলে মুখে বেশি লালা আসতে পারে।
✅ পেটে অতিরিক্ত অ্যাসিড তৈরি হলে এটি মুখে লালার প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়।
৩. স্নায়ুবিক সমস্যা
✅ পারকিনসন’স ডিজিজ, স্ট্রোক, সেরিব্রাল পালসি বা নার্ভের দুর্বলতা থাকলে মুখের পেশিগুলো লালা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, ফলে অতিরিক্ত লালা বের হয়।
৪. গর্ভাবস্থা
✅ গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে অনেক নারীর মুখে বেশি লালা তৈরি হয়, যা হরমোনজনিত পরিবর্তনের কারণে ঘটে।
৫. কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
✅ কিছু ওষুধ যেমন অ্যান্টিসাইকোটিক, ট্রাঙ্কুইলাইজার বা মাউথ ইনফেকশনের অ্যান্টিবায়োটিক অতিরিক্ত লালা উৎপাদন করতে পারে।
৬. অ্যালার্জি বা খাবারের প্রতিক্রিয়া
✅ কিছু খাবার (বিশেষ করে মসলাযুক্ত ও টকজাতীয় খাবার) খাওয়ার পর লালা বেশি আসতে পারে।
✅ অ্যালার্জির কারণে মুখের সংবেদনশীলতা বেড়ে গেলে লালা উৎপাদনও বেড়ে যায়।
৭. মুখের গঠনগত সমস্যা
✅ দাঁতের অস্বাভাবিক গঠন বা চোয়ালের সমস্যা থাকলে লালা সঠিকভাবে গলায় প্রবাহিত না হয়ে মুখে জমতে পারে।
৮. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ
✅ অতিরিক্ত মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা থাকলে অনেকের মুখে বেশি লালা জমতে পারে।
৯. ঘুমের সময় মুখ খোলা থাকা
✅ ঘুমের সময় মুখ খোলা থাকলে লালা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে অতিরিক্ত লালা বের হয়।
মুখে অতিরিক্ত লালা আসার প্রতিকার
অতিরিক্ত লালা উৎপাদন সমস্যার কারণ অনুযায়ী বিভিন্ন সমাধান রয়েছে। নিচে কিছু কার্যকর প্রতিকার দেওয়া হলো:
১. দাঁতের যত্ন নিন ও মুখ পরিষ্কার রাখুন
✅ প্রতিদিন দুইবার ব্রাশ করুন ও ফ্লস ব্যবহার করুন।
✅ মাউথওয়াশ ব্যবহার করলে মুখের ব্যাকটেরিয়া কমে যাবে এবং লালা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
২. গ্যাস্ট্রিক বা এসিডিটি নিয়ন্ত্রণ করুন
✅ অতিরিক্ত ঝাল ও টক খাবার এড়িয়ে চলুন।
✅ রাতে খাওয়ার পরপরই শুয়ে পড়বেন না, অন্তত ২-৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করুন।
✅ প্রয়োজনে অ্যান্টাসিড বা ডাক্তারের পরামর্শে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ গ্রহণ করুন।
৩. মুখের ব্যায়াম করুন
✅ চোয়ালের পেশি ও গলার ব্যায়াম করলে লালা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।
✅ প্রতিদিন জিভ ও মুখের পেশির স্ট্রেচিং ব্যায়াম করুন।
৪. পর্যাপ্ত পানি পান করুন
✅ পানি কম পান করলে মুখের শুষ্কতা বেড়ে গিয়ে লালার ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
✅ প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
৫. মানসিক চাপ কমান
✅ ধ্যান ও শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যায়াম করলে মানসিক চাপ কমে এবং লালা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
✅ পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন।
৬. ওষুধ পরিবর্তন বা ডাক্তারের পরামর্শ নিন
✅ যদি কোনো ওষুধের কারণে সমস্যা হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বিকল্প ওষুধ ব্যবহার করুন।
৭. সঠিক ঘুমের ভঙ্গি বজায় রাখুন
✅ ঘুমানোর সময় মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করুন।
✅ পাশ ফিরে ঘুমানো বা উঁচু বালিশ ব্যবহার করলে লালা মুখে জমতে পারে না।
৮. ডাক্তার দেখানো জরুরি হলে
যদি মুখে অতিরিক্ত লালা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে এবং স্বাভাবিক কার্যকলাপে ব্যাঘাত ঘটায়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে যদি –
🚨 মুখের পেশি দুর্বল হয়ে যায়
🚨 গলাধঃকরণে সমস্যা হয়
🚨 অপ্রয়োজনীয় লালা ঝরতে থাকে
🚨 ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে
উপসংহার
মুখে অতিরিক্ত লালা আসা সাময়িক ও স্বাভাবিক হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদী হলে এটি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে মুখের সংক্রমণ, এসিডিটি, মানসিক চাপ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। তবে, কিছু ঘরোয়া প্রতিকার ও জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্যা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যদি সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আপনার কি কখনো মুখে অতিরিক্ত লালার সমস্যা হয়েছে? কীভাবে আপনি এটি সামলেছেন? কমেন্টে আমাদের জানান!