সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি পরিবার ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব

সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) বিশ্বের অন্যতম প্রধান প্রবাসী গন্তব্য, যেখানে লাখো বাংলাদেশি শ্রমিক এবং তাদের পরিবার বসবাস করেন। যদিও UAE-তে প্রবাসী বাংলাদেশি পরিবারের জন্য উন্নত জীবনযাত্রার সুযোগ রয়েছে, তবে তারা অনেক সময় সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হন। স্থানীয় আরবি সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হতে পারে, যা পারিবারিক সম্পর্ক, শিশুর বিকাশ এবং মানসিক সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, যখন প্রবাসী বাংলাদেশি পরিবাররা স্থানীয় সমাজের সাথে নিজেদের সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় করতে চেষ্টা করেন, তখন অনেক সময় তারা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।

এই ব্লগে, আমরা আলোচনা করব কীভাবে বাংলাদেশি পরিবাররা UAE-তে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হন এবং এটি তাদের পারিবারিক জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলে।

১. সংস্কৃতির পার্থক্য ও পরিবারে প্রভাব

১.১ বাংলাদেশি সংস্কৃতি এবং স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য

UAE-তে বাংলাদেশি পরিবাররা দুটি সংস্কৃতির মধ্যে বাস করেন: একটি তাদের নিজস্ব বাংলাদেশি সংস্কৃতি এবং অন্যটি স্থানীয় আরবি সংস্কৃতি। এই দুটি সংস্কৃতির মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকতে পারে, যেমন খাওয়া-দাওয়া, পোশাক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং সামাজিক মূল্যবোধের দিক থেকে। এই সাংস্কৃতিক পার্থক্য অনেক সময় পরিবারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে শিশুরা যখন দুটি সংস্কৃতির মধ্যে মিশতে চেষ্টা করে।

raju akon youtube channel subscribtion

১.২ ধর্মীয় পার্থক্য এবং সামাজিক মানসিকতা

UAE-তে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ রয়েছে, তবে বিভিন্ন ধর্মের মানুষও বসবাস করেন। বাংলাদেশি মুসলিম পরিবাররা নিজেদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাসের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, তবে তারা যখন স্থানীয় সমাজের প্রথা এবং মূল্যবোধের সঙ্গে মেলে না, তখন সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে। পরিবারগুলো কখনো কখনো তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক নিয়মাবলী মেনে চলতে চায়, কিন্তু স্থানীয় সমাজের সাথে সাংস্কৃতিক পার্থক্য থাকে, যা তাদের মধ্যে চাপ সৃষ্টি করে।

২. পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব

২.১ বাবা-মায়ের কর্তৃত্ব এবং সন্তানের স্বাধীনতা

UAE-তে বাংলাদেশি পরিবারগুলোর মধ্যে কখনো কখনো বাবা-মায়ের কর্তৃত্ব এবং সন্তানের স্বাধীনতার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশি পরিবারে বাবা-মা সাধারণত পরিবারে প্রধান কর্তৃত্ব রাখেন, কিন্তু স্থানীয় সমাজে শিশুদের অধিক স্বাধীনতা এবং নিজস্ব মতামত প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। শিশুরা যখন স্থানীয় সমাজের প্রভাবে তাদের স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশ করে, তখন এটি পরিবারের মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে। বাবা-মা চান তাদের সন্তানরা তাদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুক, কিন্তু সন্তানরা স্থানীয় সংস্কৃতি অনুসরণ করতে চাইতে পারে, যা পারিবারিক সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

২.২ পিতামাতার কর্মজীবন এবং শিশুর মনোভাব

UAE-তে প্রবাসী পরিবারগুলো সাধারণত দীর্ঘ কাজের ঘণ্টা এবং কর্মস্থলের চাপের মধ্যে থাকে। বাবা-মা যখন কঠোর পরিশ্রম করেন এবং সন্তানদের জন্য যথেষ্ট সময় দেন না, তখন এটি পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। সন্তানরা মাঝে মাঝে তাদের বাবা-মায়ের মনোযোগের অভাব অনুভব করে এবং একাকীত্ব বা মানসিক চাপের শিকার হতে পারে।

৩. শিশুর মানসিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব

৩.১ শিশুর সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি

বাংলাদেশি শিশুরা UAE-তে বেড়ে উঠতে গিয়ে তাদের মা-বাবার সংস্কৃতি এবং স্থানীয় সমাজের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি অনুভব করতে পারে। তারা নিজেদের বাংলাদেশি সাংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে চায়, তবে স্থানীয় সমাজের মধ্যে মিশে যেতে গিয়ে নিজেদের অন্য রকম অনুভব করতে পারে। এই সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি তাদের আত্মবিশ্বাসের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং তারা কখনো নিজেকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন বা অপ্রাসঙ্গিক মনে করতে পারে।

৩.২ ভাষাগত সমস্যা

বাংলাদেশি শিশুদের মধ্যে ভাষাগত সমস্যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যদিও তারা বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত, তবে তাদের স্কুল এবং সমাজের প্রভাবের কারণে তারা আরবি এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হতে চেষ্টা করে। এই ভাষাগত সমস্যা তাদের মানসিক চাপ এবং সামাজিকীকরণের মধ্যে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও, তারা স্থানীয় সমাজে নিজেদের চিন্তা প্রকাশ করতে এবং বন্ধু তৈরি করতে সমস্যায় পড়তে পারে।

৪. সংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব মোকাবিলার উপায়

৪.১ সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা

বাংলাদেশি পরিবারদের উচিত তাদের সন্তানদের মাঝে দুটি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা। তারা তাদের নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করতে পারবে, তবে একই সঙ্গে স্থানীয় সমাজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। শিশুদের সঠিকভাবে সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে জানানো উচিত যাতে তারা উভয় সংস্কৃতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।

৪.২ পাশাপাশি শেখা এবং মানিয়ে নেওয়া

বাবা-মা এবং শিশুরা উভয়ই স্থানীয় সমাজের সংস্কৃতি ও নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। স্থানীয় সমাজে সন্তানদের ভালোভাবে মানিয়ে নেওয়ার জন্য বাবা-মা তাদের সহায়তা করতে পারেন এবং এই প্রক্রিয়ায় তাদের ভাষাগত এবং সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারেন।

৪.৩ পারিবারিক সম্পর্ক শক্তিশালী করা

বাবা-মায়ের উচিত তাদের সন্তানদের জন্য সময় বের করা এবং একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করা। একটি শক্তিশালী পারিবারিক ভিত্তি শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক হতে পারে এবং তারা সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হলে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।

৪.৪ সামাজিক সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করা

অন্য প্রবাসী পরিবারগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়া এবং স্থানীয় কমিউনিটিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা শিশুর মানসিক চাপ কমাতে এবং সামাজিকীকরণে সহায়ক হতে পারে। শিশু যদি স্থানীয় কমিউনিটিতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিশতে পারে, তবে তাদের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব কমে যাবে।

UAE-তে বাংলাদেশি পরিবারের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, সঠিক সমর্থন এবং সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে এটি মোকাবিলা করা সম্ভব। সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পারিবারিক সম্পর্কের শক্তিশালী ভিত্তি, এবং শিশুদের জন্য একটি ইতিবাচক সামাজিক পরিবেশ তৈরি করা, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। UAE-তে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি শিশুদের সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অনলাইনে কাউন্সেলিং সেবার জন্য আমার ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করুন: rajuakon.com/contact

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *