বর্তমান সময়ে টিকটক, ইনস্টাগ্রাম এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে টিকটকের আসক্তি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ভিডিও বানানো, লাইক এবং শেয়ার পাওয়া যেন তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করেন যে এটি শুধুমাত্র বিনোদনের একটি মাধ্যম, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে টিকটকের অতিরিক্ত ব্যবহার তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
টিকটকের প্রভাব:
টিকটক একটি ছোট ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম যেখানে ব্যবহারকারীরা নানান ধরণের ভিডিও তৈরি করে। এই প্ল্যাটফর্মটি তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। তবে অতিরিক্ত এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে টিকটক ব্যবহারের ফলে বেশ কিছু মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষত টিকটকের অ্যালগরিদম এমনভাবে তৈরি হয়েছে যা ব্যবহারকারীদের দীর্ঘ সময় ধরে অ্যাপে আটকে রাখে, এবং এটি তরুণদের মনোজগতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।
১. আত্মমর্যাদার ক্ষতি:
টিকটক ব্যবহারকারীরা সাধারণত অন্যদের থেকে লাইক, শেয়ার এবং কমেন্টের মাধ্যমে মানসিকভাবে স্বীকৃতি পেতে চায়। তবে যখন তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে লাইক বা কমেন্ট পায় না, তখন তাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে। এর ফলে নিজেকে কম মূল্যবান মনে করা শুরু করে, যা দীর্ঘমেয়াদে বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
২. অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা:
টিকটক প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন অসংখ্য নতুন ভিডিও পোস্ট করা হয়। প্রতিযোগিতার মাত্রা এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, একজন ব্যবহারকারী নিজেকে সর্বদা অন্যদের চেয়ে ভালো প্রমাণ করতে চায়। এর ফলে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। এটি একটি ক্ষতিকর প্রভাব যা তরুণদের মনের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
৩. ধৈর্যের অভাব:
টিকটকের ভিডিওগুলি সাধারণত মাত্র ১৫-৬০ সেকেন্ডের মধ্যে তৈরি হয়, এবং এই স্বল্প সময়ের বিনোদন তরুণদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব তৈরি করছে। তারা আর দীর্ঘ সময় ধরে কোনো কাজ করতে বা মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। এটি শিক্ষায় এবং দৈনন্দিন জীবনের কাজে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
মানসিক রোগের সূচনা:
টিকটকের আসক্তি তরুণদের মধ্যে এক নতুন প্রজন্মের মানসিক রোগের সূচনা করছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে টিকটক ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে অবসাদ, একাকীত্ব, এবং অসংলগ্ন মনোযোগের সমস্যা দেখা দেয়। টিকটক ব্যবহারকারীরা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এবং ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সময় কাটাতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। এর ফলে মানসিক বিকার এবং আচরণগত সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
কীভাবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?
টিকটক বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে কিছু নিয়ম এবং সচেতনতার মাধ্যমে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
১. নিয়ন্ত্রিত সময়ব্যবস্থা:
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রিত সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। প্রতিদিন কতক্ষণ সময় টিকটকে বা অন্য অ্যাপে ব্যয় করা হচ্ছে, তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
২. বাস্তব জীবনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা:
ভার্চুয়াল দুনিয়ার পাশাপাশি বাস্তব জীবনের সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার, বন্ধু এবং কাছের মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানো, প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশা করা এবং সামাজিক ক্রিয়াকলাপে অংশ নেওয়া মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
৩. মেডিটেশন ও মাইন্ডফুলনেস চর্চা:
মেডিটেশন এবং মাইন্ডফুলনেস চর্চা তরুণদের মানসিক শান্তি এবং মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করতে পারে। এটি উদ্বেগ ও মানসিক চাপ কমাতে কার্যকর।
৪. আত্মউন্নয়নের দিকে মনোযোগ:
টিকটকের পরিবর্তে নিজের সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। নতুন কিছু শেখা, পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া এবং শরীরচর্চা করার মতো ইতিবাচক কার্যকলাপে নিজেদের নিয়োজিত করা উচিত।
সমাপনী কথা:
টিকটক প্ল্যাটফর্মটি বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, তবে এর অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। একটি নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে টিকটকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলির মাধ্যমে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আমাদের উচিত সময়মতো সতর্ক হওয়া এবং তরুণদেরকে সামাজিক মাধ্যমের সঠিক ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন করা। টিকটকের নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করা সময়ের দাবি।