অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (ASD) হলো এক ধরনের নিউরোডেভেলপমেন্টাল সমস্যা, যা শিশুর সামাজিক, যোগাযোগমূলক এবং আচরণগত বিকাশকে প্রভাবিত করে। প্রাথমিক পর্যায়ে অটিজম শনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সময়মতো নির্ণয় হলে চিকিৎসা ও থেরাপির মাধ্যমে সন্তানের বিকাশে সহায়তা করা যায়। কিছু লক্ষণ এবং আচরণ আছে যা দেখে আপনি ধারণা করতে পারেন আপনার বাচ্চার মধ্যে অটিজম রয়েছে কি না।
১. সামাজিক যোগাযোগের সমস্যাঃ
অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত অন্যদের সাথে সামাজিক যোগাযোগে অসুবিধা অনুভব করে। নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো আপনি লক্ষ্য করতে পারেন:
- চোখের যোগাযোগ এড়ানো।
- অন্যদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ না দেখানো।
- কারও নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া।
- সামাজিক মজার বা আনন্দদায়ক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ না করা।
২. ভাষাগত ও যোগাযোগের সমস্যাঃ
অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে সাধারণত ভাষাগত বিকাশে বিলম্ব ঘটে এবং তারা যোগাযোগে সমস্যার সম্মুখীন হয়। কিছু লক্ষণ হতে পারে:
- বয়স অনুযায়ী কথা না বলা বা ভাষা বিকাশে দেরি হওয়া।
- কথার অর্থ বুঝতে বা কথা ধরে রাখতে সমস্যা।
- কথা বললেও সঠিক প্রেক্ষাপটে না বলা বা একাধিকবার একই কথা বলা।
- অপ্রাসঙ্গিক বা অবাস্তব শব্দ ব্যবহার করা।
৩. আচরণগত বৈশিষ্ট্যঃ
অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ ও সীমাবদ্ধ আগ্রহ দেখা যায়। এগুলো হতে পারে:
- কোনো নির্দিষ্ট কাজ বা আচরণ বারবার করা, যেমন হাত নাড়া বা একই শব্দ করা।
- দৈনন্দিন রুটিনে সামান্য পরিবর্তন হলে অস্বস্তি বা উদ্বেগ দেখা দেওয়া।
- কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা খেলনা নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ থাকা এবং অন্য কিছুতে মনোযোগ না দেওয়া।
- ঘূর্ণায়মান বস্তু বা আলোতে বাড়তি আগ্রহ।
৪. সংবেদনশীলতাঃ
অটিজম শিশুদের মধ্যে অনেক সময় অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা (হাইপারসেনসিটিভিটি) বা সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া (হাইপোসেনসিটিভিটি) দেখা যায়। কিছু লক্ষণ হতে পারে:
- উজ্জ্বল আলো, জোরে শব্দ বা স্পর্শে অস্বস্তি অনুভব করা।
- কিছু নির্দিষ্ট গন্ধ, স্বাদ বা টেক্সচার পছন্দ না করা।
- শারীরিক ব্যথা বা ঠান্ডা-গরম অনুভব করা নিয়ে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
৫. সামাজিক খেলা ও কল্পনাশক্তির অভাবঃ
অটিজম আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত সামাজিক খেলা বা কল্পনাশক্তি নিয়ে খেলার সময় সমস্যা অনুভব করে। তারা সাধারণত:
- অন্য শিশুদের সাথে খেলায় আগ্রহী না।
- খেলায় কোনো চরিত্রের ভূমিকা পালন করতে চায় না।
- কোনো খেলনার সাথে সৃজনশীলভাবে খেলতে সমস্যা অনুভব করে, যেমন গাড়ি খেলনাটি শুধু একদিকে গড়িয়ে দেওয়া।
৬. শারীরিক বিকাশের ব্যতিক্রমঃ
কিছু অটিজম আক্রান্ত শিশুদের শারীরিক বিকাশে অনিয়ম দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
- মোটর স্কিলের উন্নতিতে বিলম্ব হওয়া, যেমন হাঁটতে বা দৌড়াতে দেরি হওয়া।
- হাত বা পা ঘুরানো বা অস্বাভাবিক গতিতে দৌড়ানো।
- দিকনির্দেশ বুঝতে বা বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করতে সমস্যার সম্মুখীন হওয়া।
৭. ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশে সীমাবদ্ধতাঃ
অটিজম শিশুরা সাধারণত নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে এবং অন্যের অনুভূতি বুঝতে সমস্যার সম্মুখীন হয়। তারা:
- অন্যের আবেগ বা অনুভূতির সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে না।
- অন্যের হাসি, কান্না বা ব্যথা নিয়ে চিন্তিত না হওয়া।
- নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে সমস্যা অনুভব করা।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
উপরোক্ত লক্ষণগুলোর কোনো একটি বা একাধিক যদি আপনার সন্তানের মধ্যে দেখতে পান, তবে দেরি না করে একজন শিশুবিশেষজ্ঞ বা শিশু মনোবিজ্ঞানীর সাথে যোগাযোগ করুন। প্রাথমিক পর্যায়ে অটিজম শনাক্ত হলে চিকিৎসা ও থেরাপির মাধ্যমে সন্তানের বিকাশে সহায়তা করা যায় এবং তার জীবনকে আরও সুস্থ ও সুখী করা যায়।
উপসংহার
অটিজমের লক্ষণগুলো সব শিশুর মধ্যে সমানভাবে প্রকাশ পায় না। কিছু শিশু মৃদু অটিজম নিয়ে জন্মায়, আবার কিছু শিশুর মধ্যে এটি গভীরভাবে দেখা দেয়। তবে যেকোনো লক্ষণ দ্রুত শনাক্ত করে পেশাদার সহায়তা নেয়া অত্যন্ত জরুরি। সময়মতো চিকিৎসা পেলে অটিজম শিশুর জীবন যাত্রার মান অনেকটাই উন্নত করা সম্ভব।