যুক্তরাজ্যে পরকীয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠেছে, যা বেশ কিছু পরিবার এবং সম্পর্কের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। প্রবাসী সম্প্রদায় থেকে শুরু করে ব্রিটিশ সমাজের মধ্যেও পরকীয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও পরকীয়া একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা, তবে যুক্তরাজ্যে এর প্রকৃতি এবং তা বাড়ার কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে। সমাজিক পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক পার্থক্য, মানসিক চাপ, এবং সম্পর্কের মধ্যে আস্থাহীনতা পরকীয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। চলুন, দেখি যুক্তরাজ্যে পরকীয়া কেন বেশি হচ্ছে এবং এর মানসিক বিশ্লেষণ কী হতে পারে।
১. সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি এবং অন্যান্য অভিবাসী দম্পতিদের জন্য, নতুন সমাজে এসে তাদের সামাজিক নীতিগুলো পরিবর্তিত হতে পারে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অভ্যস্ততা, সমাজের মুক্ত মানসিকতা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার কারণে অনেক সময় সম্পর্কের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। যেহেতু পশ্চিমা সমাজে একক যৌনতা বা সম্পর্কের প্রতি আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, অনেকেই মনে করেন যে, পরকীয়া একটি সাধারণ বিষয় এবং এটা অনেক সময় স্বাভাবিকভাবেই ঘটতে পারে।
২. প্রযুক্তির উন্নতি এবং অনলাইনে সম্পর্ক গঠন
যুক্তরাজ্যে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সহজে নতুন সম্পর্ক গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অনলাইন ডেটিং এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগের সুযোগ পরকীয়াকে আরও সহজ এবং স্বীকৃত করতে সাহায্য করছে। মানুষ সহজেই নিজেদের অনুভূতি, আকর্ষণ এবং সম্পর্কের বাইরে অন্য কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। পরকীয়া তখনই ঘটে যখন দম্পতির মধ্যে মানসিক বা শারীরিক তৃপ্তি না পাওয়া যায় এবং অন্য কাউকে পাওয়া যায়, যারা তাদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।
৩. সম্পর্কের মধ্যে একঘেয়েমি ও চাহিদার অমিল
অধিকাংশ দম্পতি একে অপরের প্রতি নতুনত্ব এবং আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘদিন একসাথে থাকার পর, অনেক সময় সম্পর্কের মধ্যে একঘেয়েমি চলে আসে এবং একে অপরের থেকে মানসিক বা শারীরিক তৃপ্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে, কেউ কেউ পরকীয়া করতে পারেন একঘেয়েমি কাটানোর জন্য বা অন্য কাউকে নিজের মতো করে অনুভব করতে চান। অনেক সময় দম্পতি তাদের সম্পর্কের সীমাবদ্ধতাগুলো দেখতে পান এবং নতুন কোনও সম্পর্কের মাধ্যমে নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করতে চান।
৪. মানসিক চাপ এবং অসন্তুষ্টি
যুক্তরাজ্যে প্রবাসী জীবন অনেক সময় মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের সৃষ্টি করে, যা সম্পর্কের মধ্যে অস্থিরতা আনতে পারে। অর্থনৈতিক চাপ, পরিবারের দায়িত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, এসব একটি সম্পর্কের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি করে। যখন একজন দম্পতি মানসিকভাবে অসন্তুষ্ট বা চাপের মধ্যে থাকেন, তারা অন্য কোথাও তৃপ্তি বা খুশি খোঁজার জন্য পরকীয়ার দিকে এগিয়ে যেতে পারেন। অনেক সময় এটা এক ধরনের মানসিক পালিয়ে যাওয়ার বা সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে দেখা হয়।
৫. সম্পর্কের মধ্যে আস্থাহীনতা এবং বিচ্ছিন্নতা
একটি সম্পর্কের মুল ভিত্তি হচ্ছে আস্থা। যখন দম্পতির মধ্যে আস্থা এবং বিশ্বাসের অভাব হয়, তখন সম্পর্কের মধ্যে ভাঙন শুরু হয়। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত দম্পতিদের মধ্যে, বিশেষত যারা প্রবাসী, তাদের মধ্যে পরিবারের প্রতি দীর্ঘমেয়াদী আস্থাহীনতা এবং সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা দেখা দিতে পারে। এই পরিস্থিতি পরকীয়ার জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে একজন অংশীদার অন্যত্র খুশি বা তৃপ্তি খুঁজে পায়।
৬. যৌন চাহিদার পার্থক্য
যৌন চাহিদার পার্থক্য বা অসন্তুষ্টি অনেক সময় পরকীয়ার কারণ হয়ে ওঠে। যেহেতু ব্রিটেনে যৌনতার প্রতি মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তাই সম্পর্কের মধ্যে একে অপরের যৌন চাহিদা পূরণ করতে না পারলে, একজন পার্টনার অন্য কোথাও এই তৃপ্তি খুঁজে নিতে পারেন। সামাজিকভাবে, অনেকে এটাকে অন্যরকম ভাবে না দেখে একটি “স্বাভাবিক” বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন, এবং এটি পরকীয়ার প্রবণতা বাড়ায়।
৭. ব্যস্ততা এবং সময়ের অভাব
যুক্তরাজ্যের জীবনযাত্রা খুবই ব্যস্ত, এবং অনেক দম্পতি একে অপরের সাথে সময় কাটানোর জন্য যথেষ্ট সময় পান না। এই সময়ের অভাব এবং একে অপরকে যথাযথ মনোযোগ না দেওয়ার কারণে, দম্পতির মধ্যে সম্পর্কের মান কমে যায়। কেউ যদি নিজের সঙ্গীর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ না দেয়, তবে তারা অন্য কারও কাছ থেকে মানসিক সাপোর্ট বা ভালোবাসা খুঁজে নিতে পারে, যা পরকীয়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সমাধান: পরকীয়া প্রতিরোধে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ
- খোলামেলা আলোচনা এবং সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ: পরকীয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো একে অপরের প্রতি মনোযোগ এবং খোলামেলা আলোচনা। সম্পর্কের মধ্যে আন্তরিক আলোচনা এবং একে অপরকে সমর্থন করা প্রয়োজন।
- আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা: সম্পর্কের মধ্যে আস্থা এবং বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের জন্য একে অপরকে সম্মান এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে সহায়তা করা উচিত।
- প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত করা: সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন ডেটিংয়ের ব্যবহার সীমিত করার মাধ্যমে সম্পর্কের বাইরে অন্য কোনো ব্যক্তি বা সম্পর্ক গড়ে তোলার সম্ভাবনা কমানো যায়।
- মাঝে মাঝে নতুন কিছু করা: একঘেয়েমি কাটাতে সম্পর্কের মধ্যে নতুনত্ব এবং রোমান্স আনুন। মাঝে মাঝে একে অপরের সাথে সময় কাটানো এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্পর্ককে শক্তিশালী করে।
- মনের শান্তি: মানসিক চাপ কমানোর জন্য নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, যোগব্যায়াম বা অন্যান্য সৃজনশীল কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করা উচিত।
যুক্তরাজ্যে পরকীয়া বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং মানসিক কারণ রয়েছে। তবে, সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরকীয়াকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা, আস্থা এবং খোলামেলা আলোচনা, এটি পরকীয়ার সম্ভাবনা কমাতে পারে এবং দম্পতিদের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।