ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে স্ট্রেস এবং ডিপ্রেশন একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হয়ে উঠেছে। যদিও এটি একটি বহুজাতিক সমাজ, তবে বাংলাদেশি প্রবাসীরা বেশ কিছু মানসিক চাপের সম্মুখীন হন, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অর্থনৈতিক চাপ এবং পারিবারিক সমস্যা অন্যতম প্রধান কারণ। চলুন, দেখি কেন ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে স্ট্রেস ও ডিপ্রেশন বেশি এবং কীভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করা যায়।
১. সংস্কৃতিগত পার্থক্য এবং মানসিক চাপ
ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিরা অনেক সময় নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান, কিন্তু একই সঙ্গে ব্রিটিশ সমাজের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং দ্বন্দ্বে পড়ে যান। এই সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব তাদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সন্তানদের মধ্যে ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রভাব এবং পিতামাতার পুরনো চিন্তাভাবনা কিছু সময় মানসিক অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত যদি তারা নিজেদের পরিচিত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
২. ভাষাগত সমস্যা
বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য ইংরেজি ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা অনেক সময় মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যদিও অনেক বাঙালি ইংরেজি জানেন, তবে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ভাষায় পুরোপুরি সাবলীল নয়, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে। অফিসে, স্কুলে বা সামাজিক জীবনে, সঠিকভাবে যোগাযোগ করতে না পারা অনেক সময় হতাশা এবং উদ্বেগের সৃষ্টি করে।
৩. অর্থনৈতিক চাপ
ব্রিটেনে জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেশি, এবং এই উচ্চ খরচের মধ্যে একটি পরিবার পরিচালনা করতে গেলে অনেক বাঙালি অভিবাসীকে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের সাহায্য করতে গিয়ে তাদের নিজের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা কঠিন হয়ে যায়। চাকরির নিরাপত্তাহীনতা, বেতন কম হওয়া এবং উচ্চ জীবনযাত্রার চাপ তাদের মানসিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, যা স্ট্রেস এবং ডিপ্রেশন বাড়ায়।
৪. পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা
ব্রিটেনে এসে অনেক বাঙালি তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বাংলাদেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের থেকে দূরে থাকার কারণে একাকীত্ব, বিষণ্ণতা এবং অস্থিরতা অনুভূতি হতে পারে। এটি বিশেষ করে নতুন অভিবাসীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, যারা এখনও নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছেন না। পরিবারের প্রতি দৃষ্টি এবং সম্পর্কের অভাব মানসিক চাপের সৃষ্টি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে ডিপ্রেশনে পরিণত হতে পারে।
৫. সামাজিক চাপ
ব্রিটেনে বসবাসরত অনেক বাঙালি মনে করেন, তাদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা সফল এবং সম্মানজনক, বিশেষত সমাজের অন্যান্য সদস্যদের কাছে। সামাজিক চাপ এবং নিজের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ, তাদের মানসিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অন্যদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা, সামাজিকভাবে সফল হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা, এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে সন্তুষ্টি খোঁজার চেষ্টা—এগুলো সব স্ট্রেস এবং ডিপ্রেশনের কারণ হতে পারে।
৬. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
ব্রিটেনে নতুন পরিবেশে আসা এবং সেখানকার সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে অনেক বাঙালি একাকীত্ব অনুভব করেন। যদিও প্রবাসী কমিউনিটি রয়েছে, তবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা এবং জীবনযাত্রার পার্থক্যের কারণে তাদের সামাজিক সম্পর্ক খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে না। বন্ধুদের অভাব এবং একাকীত্বের অনুভূতি মানসিক চাপ বাড়ায় এবং ডিপ্রেশনের সম্ভাবনা তৈরি করে।
৭. স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব
বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে অনেকেই এখনও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন নন এবং এই বিষয়ে সহায়তা নেওয়া লজ্জাজনক মনে করেন। তারা বিশ্বাস করেন যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা শুধুমাত্র “মনের দুর্বলতা” এবং এ ধরনের সমস্যাগুলি নিয়ে কথা বলা তাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। এই কারণে, তারা সাধারণত মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নেন না, যার ফলে তাদের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠে এবং স্ট্রেস বা ডিপ্রেশন আরও বৃদ্ধি পায়।
৮. তিন প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য
ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালি পরিবারের মধ্যে, প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। পিতামাতার পুরনো চিন্তা-ধারা, এবং নতুন প্রজন্মের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা এবং বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। বিশেষত, সন্তানরা যখন ব্রিটিশ সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত হয়ে ওঠে, তখন এটি পরিবারের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।
সমাধান: কীভাবে স্ট্রেস ও ডিপ্রেশন কমানো যাবে?
- সামাজিক সম্পর্ক গঠন: নতুন বন্ধু তৈরি করা এবং স্থানীয় কমিউনিটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
- ভাষার দক্ষতা উন্নয়ন: ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বাড়ানো মানসিক অস্থিরতা কমাতে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
- পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখা: পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারলে একাকীত্ব এবং স্ট্রেস কমানো সম্ভব।
- মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা গ্রহণ: স্ট্রেস এবং ডিপ্রেশন মোকাবেলা করতে পেশাদার সহায়তা নেওয়া উচিত। কাউন্সেলিং, থেরাপি বা সাইকোলজিস্টের সাহায্য নেওয়া এই সমস্যা কমাতে পারে।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: শারীরিক ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক স্বাস্থ্যকে শক্তিশালী করে।
- আর্থিক পরিকল্পনা: বাজেট তৈরি করে এবং সঠিকভাবে খরচ নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনৈতিক চাপ কমানো সম্ভব।
ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে স্ট্রেস এবং ডিপ্রেশন একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, এটি মোকাবেলা করার জন্য বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ রয়েছে। মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের সঙ্গে লড়াই করতে সামাজিক সমর্থন, ভাষাগত দক্ষতা, পারিবারিক সম্পর্ক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রয়োজন। যদি আপনি অনুভব করেন যে আপনার জীবনে স্ট্রেস বা ডিপ্রেশন বেশি, তবে সঠিক সহায়তা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি, রাজু আকন (কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট), আপনাকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। আপনি rajuakon.com/contact-এ যোগাযোগ করে যে কোনো সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারেন।