বিশ্বায়নের যুগে আজকাল অনেক পরিবারই তাদের কর্মজীবন এবং জীবিকার জন্য বিদেশে চলে যায়। এই প্রক্রিয়ায়, তাদের সঙ্গে চলে আসে সন্তানরা, যারা এক নতুন পরিবেশে বড় হয়ে ওঠে। প্রবাসী শিশুদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তারা একদিকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চায়, আবার অন্যদিকে তারা তাদের দেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকে। এর ফলে শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপ, একাকীত্ব, পরিচিতির অভাব এবং সেপারেশন অ্যাংজাইটি (বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতার উদ্বেগ) সৃষ্টি হতে পারে।
তবে, প্রবাসী শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য কিছু কার্যকরী উপায় রয়েছে যা তাদের মানসিক সুস্থতা এবং আবেগগত স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সহায়তা করতে পারে।
১. প্রবাসী শিশুর সামাজিক সংযোগ তৈরি করা
প্রথমত, প্রবাসী শিশুকে নতুন সমাজে সামাজিক সংযোগ গড়তে সাহায্য করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একেকটি প্রবাসী শিশু তার দেশের সংস্কৃতি, ভাষা, এবং পরিবেশ থেকে পুরোপুরি আলাদা একটি পরিবেশে চলে আসে। এই নতুন পরিবেশে তারা একাকী এবং অস্বস্তি বোধ করতে পারে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
তাদের বন্ধু-বান্ধব তৈরি করতে সহায়তা করা, স্কুলে সহপাঠীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ানো যায়। এর ফলে তারা নতুন বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবে এবং একাকীত্বের অনুভূতি কমবে।
২. অভ্যস্ত পরিবেশে ফিরে আসার চেষ্টা
প্রবাসী শিশুর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি হলো দেশ ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য। নতুন ভাষা শিখতে, নতুন সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, এবং অভ্যস্ত পরিবেশ থেকে আলাদা হওয়া তাদের জন্য খুবই কঠিন হতে পারে। তাই, বাবা-মা তাদের সন্তানদের দেশে থাকার সময়ে কিছু সান্নিধ্যপূর্ণ ও পরিচিত অভিজ্ঞতা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
এমন কিছু কাজ, যেমন তাদের প্রিয় খাবার রান্না করা, দেশে ফিরে আসা সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু ঘটনা বা গল্প শোনানো, এবং প্রবাসী জীবনে নিজেদের মতো করে কোনো ঐতিহ্য বা রীতি পালন করা, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক হতে পারে।
৩. বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা
প্রবাসী শিশুদের মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা। বাবা-মায়ের স্নেহ এবং সমর্থন শিশুর মধ্যে নিরাপত্তা এবং আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে। তারা যেন তাদের সন্তানদের অনুভূতি এবং চিন্তা-ভাবনা বুঝতে পারে, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
বাবা-মা তাদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারেন, যেমন ভিডিও কল করা, চিঠি বা মেসেজ পাঠানো, এবং ফোনে কথা বলা। সারা বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইন মাধ্যমে এই যোগাযোগ রাখা এখন খুবই সহজ। এর ফলে, শিশু তাদের পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকলেও তাদের মানসিক শান্তি বজায় থাকে।
৪. প্রফেশনাল মানসিক স্বাস্থ্য সেবা
যদি শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপ বা উদ্বেগ বেড়ে যায়, তবে তা তাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। প্রবাসী শিশুদের ক্ষেত্রে এই ধরনের উদ্বেগ আরও বেশি হতে পারে, কারণ তারা তাদের দেশে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে থাকে। এর ফলে, তাদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ, বা বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে।
এই ধরনের সমস্যা হলে, পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শক বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট শিশুদের আবেগ এবং মানসিক অবস্থার বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন, যা তাদের মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সহায়ক হতে পারে। এছাড়া, বাবা-মা যদি তাদের সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হন, তবে তারা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় সহায়তা নিতে পারবেন।
৫. নতুন ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া
প্রবাসী শিশুর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নতুন ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া। যে ভাষায় তারা শিক্ষা গ্রহণ করছে, সে ভাষায় কথা বলা এবং পরিবেশে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করলে তারা মানসিকভাবে বেশি স্বস্তি অনুভব করতে পারে। স্কুলে তাদের সহপাঠীদের সাথে মেলামেশা করতে সাহায্য করা, তাদের নিজস্ব ভাষাকে ভুলে না গিয়ে মিশ্রণ করা এবং স্থানীয় ভাষাও শেখানোর মাধ্যমে তাদের আবেগগত অবস্থা অনেক ভালো হতে পারে।
৬. শারীরিক এবং মানসিক কার্যকলাপের সুযোগ দেওয়া
শারীরিক কার্যকলাপ শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়ক। নিয়মিত শারীরিক কসরত, খেলা, সাইক্লিং বা নাচের মাধ্যমে শিশুর শরীর এবং মন সুস্থ থাকে। এছাড়া, যোগব্যায়াম বা মেডিটেশন কৌশলও শিশুর মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
শেষ কথা:
প্রবাসী শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। তারা যদি সন্তানের অনুভূতিগুলোকে বুঝে এবং সহানুভূতির সঙ্গে এগিয়ে যান, তবে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকতে পারে। প্রবাসে বড় হওয়া শিশুর জন্য সঠিক সাপোর্ট এবং সহায়তা প্রদান তাদের মানসিক সুস্থতা এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
অনলাইন মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং:
যদি আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ প্রবাসী শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করছেন এবং সহায়তা প্রয়োজন, তবে আপনি আমার (কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট রাজু আকন) কাছ থেকে অনলাইনে নিরাপদ ও গোপনীয় পরিবেশে মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং নিতে পারেন। আপনি rajuakon.com/contact পেজে গিয়ে পরামর্শ নিতে পারেন।