ওমানে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে পরকীয়া একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়, বিশেষত যখন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব, এবং মানসিক চাপ সম্পর্কিত অন্যান্য কারণে পরকীয়ার ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের অনেক প্রবাসী একে অপরের প্রতি সঠিকভাবে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মানসিক এবং শারীরিক চাপের কারণে তাদের বিবাহিত জীবন খারাপ হয়ে যায়, যার ফলস্বরূপ পরকীয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
এই ব্লগে, আমরা আলোচনা করব কেন ওমানে বাংলাদেশিদের মধ্যে পরকীয়া বেশি হয় এবং এর মানসিক বিশ্লেষণ কী হতে পারে।
১. পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্ব
ওমানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করতে পারে। পরিবারের সঙ্গে সঠিক যোগাযোগ এবং সমর্থন না পাওয়ার কারণে, অনেক প্রবাসী একাকীত্ব অনুভব করেন। এই একাকীত্ব মানসিক অস্থিরতা এবং হতাশা সৃষ্টি করতে পারে, যা পরকীয়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
একাকীত্বের অনুভূতি অনেক সময় শারীরিক এবং মানসিকভাবে এক ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি করে, এবং তারা সঙ্গীর কাছ থেকে অভাবিত সমর্থন বা মনোযোগ না পেয়ে অন্য কোথাও খোঁজে। যখন স্বামী বা স্ত্রী তাদের কাজের ব্যস্ততার কারণে একে অপরের পাশে না থাকেন, তখন এটি তাদের মধ্যে সম্পর্কের দুরত্ব সৃষ্টি করতে পারে, যা পরকীয়ার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
২. মানসিক চাপ এবং আর্থিক উদ্বেগ
অর্থনৈতিক চাপ এবং মানসিক উদ্বেগ অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকের জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে একজন প্রবাসী, যারা পরিবারকে সহায়তা দিতে বিদেশে আসেন, প্রায়ই উচ্চ প্রত্যাশার কারণে মানসিক চাপের শিকার হন।
এছাড়া, ওমানে সারা দিন কাজের পর শারীরিক এবং মানসিক ক্লান্তি তাদের মধ্যে হতাশা এবং একাকীত্ব সৃষ্টি করতে পারে। এই চাপের মধ্যে পরকীয়া তাদের জন্য একটি পথ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে, যেখানে তারা নিজেদের কষ্ট বা হতাশা থেকে কিছু মুহূর্তের জন্য মুক্তি পেতে চান। পরকীয়া অনেক সময় এই চাপ থেকে একটি সান্ত্বনা বা শান্তির অনুভূতি দেয়, যদিও এটি সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।
৩. সাংস্কৃতিক মুক্তির অনুভূতি এবং স্বাধীনতা
প্রবাসী জীবন অনেক সময় ব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। যখন একজন ব্যক্তি তার দেশে বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন সে নিজেকে আরো স্বাধীন অনুভব করতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে তাকে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক রীতিনীতির বাইরে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা এবং সম্পর্ক খোঁজার প্রবণতা থাকতে পারে।
ওমানে বাংলাদেশি শ্রমিকরা একটি নতুন পরিবেশে থাকেন এবং তাদের চারপাশের মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ার প্রলোভন তাদের মধ্যে পরকীয়া ঘটানোর দিকে ঠেলে দিতে পারে। সেখানে, তারা নতুন বন্ধু এবং সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন, যা তাদের পারিবারিক জীবন থেকে আলাদা এক ধরনের মুগ্ধতা এনে দেয়।
৪. প্রযুক্তি এবং যোগাযোগের সহজলভ্যতা
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে, সামাজিক মিডিয়া এবং ডিজিটাল যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলো মানুষকে একে অপরের সাথে সহজে যোগাযোগ করতে সহায়তা করে, এবং প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা তাদের দেশের বাইরে থেকেও সহজে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন।
এই অনলাইন যোগাযোগগুলো অনেক সময় সঙ্গীর কাছ থেকে অনুপস্থিত থাকার কারণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে উঠতে সহায়ক হয়। সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্তি তৈরি হয়ে, তারা নিজেদের সম্পর্ক থেকে কিছুটা উত্তরণ খোঁজে। এটি তাদের জন্য মানসিক চাপ কমানোর একটি পন্থা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি সম্পর্কের মধ্যে দুরত্ব এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারে।
৫. পারিবারিক অস্থিরতা এবং সম্পর্কের অভাব
বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্কের অস্থিরতা এবং একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠার জন্য একটি উর্বর মাটি তৈরি করতে পারে। যখন দম্পতিদের মধ্যে ভালো সম্পর্কের অভাব থাকে, তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার অভাব হয়, তখন তারা বাইরে থেকে অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং সমর্থন খোঁজেন।
প্রায়ই, পরিবারের সদস্যরা একে অপরের কাছ থেকে মানসিক সমর্থন না পেয়ে পরকীয়ার দিকে চলে যান। সম্পর্কের প্রতি অবিশ্বাস এবং অবহেলা পরকীয়াকে আরো উৎসাহিত করে, এবং এটি একটি পরবর্তীতে সম্পর্কের বিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৬. পরকীয়ার মানসিক প্রভাব এবং সম্পর্কের ক্ষতি
ওমানে পরকীয়া ঘটানোর কারণে অনেক প্রবাসী দম্পতির মধ্যে বিশ্বাসের অভাব এবং মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। পরকীয়ার শিকার হওয়া একজন সঙ্গী অনেক সময় মানসিক অবসাদ এবং বিষণ্ণতার শিকার হন, যার কারণে তাদের সম্পর্কের মধ্যে শূন্যতা এবং তিক্ততা সৃষ্টি হয়।
এটি শুধুমাত্র দম্পতির সম্পর্কেই ক্ষতি করতে পারে না, বরং এটি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যদি তারা পরিবারের অস্থিরতা বা সম্পর্কের সমস্যা দেখে থাকে।
সমাধান: কীভাবে পরকীয়া ঠেকানো যেতে পারে?
১. খোলামেলা আলোচনা এবং সম্পর্কের উন্নতি
দম্পতিদের মধ্যে সঠিক যোগাযোগ বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের অনুভূতি এবং চিন্তা একে অপরের কাছে শেয়ার করা উচিত, যাতে কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি না হয়।
২. বিশ্বাস এবং সহযোগিতা
পরকীয়ার সমস্যা কমাতে সবার আগে বিশ্বাস এবং সহযোগিতা থাকা জরুরি। দম্পতির মধ্যে পারস্পরিক আস্থা তৈরি করতে হবে এবং একে অপরকে মানসিকভাবে সমর্থন দিতে হবে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ
যদি মানসিক চাপ বা সম্পর্কের সমস্যাগুলি গুরুতর হয়ে ওঠে, তবে কাউন্সেলিং বা থেরাপি গ্রহণ করা একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। এটি দম্পতিদের তাদের সমস্যাগুলি সমাধান করতে সাহায্য করতে পারে।
ওমানে বাংলাদেশি প্রবাসী দম্পতিদের মধ্যে পরকীয়ার ঘটনা বাড়ছে, তবে এর প্রধান কারণ হলো একাকীত্ব, মানসিক চাপ, আর্থিক উদ্বেগ এবং সম্পর্কের অভাব। তবে, সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং খোলামেলা আলোচনা, বিশ্বাস এবং সমর্থন প্রদান করে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। সম্পর্কের প্রতি নিবেদন এবং খোলামেলা সমর্থনই সুখী এবং সুস্থ দাম্পত্য জীবন নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।