কাতারে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসী পরিবারগুলো বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। নতুন পরিবেশ, ভাষাগত সমস্যা, কর্মসংস্থানজনিত চাপ, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং সামাজিকীকরণের অভাবের কারণে মানসিক সংকট বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে, পরিবারগুলোর অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক, অর্থনৈতিক চাপ, সন্তান লালন-পালন ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কাতারে বসবাসরত বাংলাদেশি পরিবারগুলোর মানসিক সংকটের কারণ
১. পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক একাকীত্ব
অনেক বাংলাদেশি কর্মী একা কাতারে কাজ করতে আসেন এবং তাদের পরিবার বাংলাদেশে থাকে। দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকার ফলে একাকীত্ব, হতাশা ও মানসিক চাপ তৈরি হয়। অন্যদিকে, যারা পরিবারসহ কাতারে বসবাস করেন, তারাও ব্যস্ত কর্মজীবনের কারণে পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না, যা মানসিক দূরত্ব তৈরি করে।
২. অর্থনৈতিক চাপ ও অনিশ্চয়তা
বাংলাদেশি অভিবাসী পরিবারগুলোর অনেকেই মধ্যম বা নিম্ন আয়ের মধ্যে বসবাস করেন। কর্মসংস্থান নিরাপত্তার অভাব, আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশে পাঠানো টাকার চাপ মানসিক উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ। বিশেষ করে, চাকরি হারানোর ভয় এবং বৈধ কাগজপত্র সংক্রান্ত জটিলতা পরিবারের মানসিক শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটায়।
৩. সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও মানসিক দ্বন্দ্ব
কাতারের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা এবং সামাজিক মূল্যবোধ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের চেয়ে আলাদা। বাংলাদেশি অভিভাবকদের সন্তানদের কাতারের আধুনিক ও বহুজাতিক সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এতে করে অভিভাবক ও সন্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং পারিবারিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৪. মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতার অভাব
বাংলাদেশি অভিবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই। হতাশা, উদ্বেগ, একাকীত্ব বা মানসিক ক্লান্তির মতো সমস্যা থাকলেও অনেকেই একে গুরুত্ব দেন না এবং চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। ফলে অনেক মানুষ নীরবে মানসিক সংকটে ভুগেন।
৫. সামাজিকীকরণের অভাব ও কমিউনিটির সাথে দূরত্ব
অনেক অভিবাসী পরিবার স্থানীয় কাতারি সমাজের সাথে মেলামেশার সুযোগ পান না। বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যেও সবাই সমানভাবে সংযুক্ত নয়। সামাজিক সম্পর্কের এই অভাব মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে এবং ব্যক্তিগত জীবনকে আরও বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
৬. কর্মক্ষেত্রের মানসিক চাপ
কাতারের বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কঠোর পরিশ্রম এবং কাজের চাপ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, নির্মাণ ও সেবা খাতে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য মানসিক চাপ আরও বেশি। অনেক সময় কর্মস্থলে বৈষম্য বা অবমূল্যায়নের শিকার হতে হয়, যা হতাশা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি করে।
৭. সন্তান লালন-পালন ও শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জ
কাতারে বসবাসরত বাংলাদেশি পরিবারগুলোর অনেকেরই সন্তানদের শিক্ষার বিষয়ে উদ্বেগ থাকে। একদিকে, স্থানীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নেওয়া এবং অন্যদিকে, বাংলা সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বজায় রাখা অনেক অভিভাবকের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে, সন্তানদের পড়াশোনা, সামাজিক জীবন এবং মানসিক বিকাশ নিয়ে বাবা-মায়ের উদ্বেগ বাড়ে।
সমাধান ও করণীয়
১. মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা উচিত। হতাশা বা উদ্বেগ অনুভব করলে পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরি।
২. পরিবার ও সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধি করা
সামাজিকীকরণের মাধ্যমে পরিবার ও কমিউনিটির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুললে মানসিক চাপ কমবে। বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পারিবারিক মিলনমেলা আয়োজন করা মানসিক প্রশান্তির জন্য সহায়ক হতে পারে।
৩. কর্মস্থলে মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা
কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ কমানোর জন্য সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করা, প্রয়োজন অনুযায়ী ছুটি নেওয়া এবং অবসর সময়ে স্বস্তিদায়ক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া উচিত।
৪. সাংস্কৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা
সন্তানদের কাতারের সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করার পাশাপাশি, তাদের নিজেদের বাংলাদেশি ঐতিহ্য ও ভাষার প্রতি সংযুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। এতে করে তারা নিজেদের পরিচয় নিয়ে মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগবে না।
৫. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নিরাপত্তা
পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা দরকার। চাকরি হারানোর ভয় বা আর্থিক অনিশ্চয়তা কমাতে বিকল্প উপার্জনের পথ খোঁজা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করাও গুরুত্বপূর্ণ।
পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নিন
যদি আপনি বা আপনার পরিবার মানসিক চাপে থাকেন এবং পেশাদার সহায়তা প্রয়োজন হয়, তাহলে অনলাইনে নিরাপদ ও গোপনীয় মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করুন: rajuakon.com/contact ।