মলদ্বারে ব্যথা একটি সাধারণ কিন্তু অস্বস্তিকর সমস্যা, যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। মলদ্বার বা পায়ুপথের সংক্রমণ, প্রদাহ, অথবা ক্ষতজনিত কারণে মলদ্বারে ব্যথা হতে পারে। কখনো কখনো এটি গুরুতর রোগেরও লক্ষণ হতে পারে।
মলদ্বারে ব্যথার সাধারণ কারণসমূহ
১. পাইলস (হেমোরয়েডস)
পাইলস বা হেমোরয়েডস হলো মলদ্বারে রক্তনালীগুলোর ফোলাভাব, যা প্রায়ই ব্যথা এবং রক্তপাতের কারণ হতে পারে। এটি মলত্যাগের সময় তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। পাইলস দুই ধরনের হয়:
- অভ্যন্তরীণ পাইলস: মলদ্বারের ভিতরে ফোলাভাব।
- বাহ্যিক পাইলস: মলদ্বারের বাইরে ফোলাভাব, যা কখনও কখনও ছিঁড়ে গিয়ে রক্তপাত ঘটায়।
২. গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল বা মলদ্বারে ফিসার (Anal Fissure)
মলদ্বারের চামড়ায় ছোট ফেটে যাওয়া বা ফিসার হলে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এটি সাধারণত কষা মলত্যাগের কারণে হয় এবং মলের সাথে সামান্য রক্তপাত দেখা যেতে পারে।
৩. মলদ্বারে ফিস্টুলা (Anal Fistula)
মলদ্বারের আশেপাশে সংক্রমণের কারণে একটি ছোট টিউবের মতো পথ তৈরি হলে সেটিকে ফিস্টুলা বলা হয়। এটি সংক্রমণজনিত কারণে ব্যথা ও ফোলাভাবের সৃষ্টি করতে পারে এবং পুঁজ নিঃসৃত হতে পারে।
৪. ইনফেকশন (সংক্রমণ)
মলদ্বারের সংক্রমণ, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের কারণে, ব্যথা ও জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে। এটি সাধারণত হাইজিন না মানার ফলে হয়।
৫. এনাল অ্যাবসেস (Anal Abscess)
মলদ্বারের আশেপাশে পুঁজ জমে গেলে তা এনাল অ্যাবসেস নামে পরিচিত। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক হতে পারে এবং এর ফলে তীব্র ফোলাভাব ও ব্যথা দেখা দিতে পারে।
৬. ইনফ্লামেটরি বোয়েল ডিজিজ (IBD)
ইনফ্লামেটরি বোয়েল ডিজিজ বা প্রদাহজনিত অন্ত্রের রোগ যেমন ক্রোনস ডিজিজ এবং আলসারেটিভ কোলাইটিস, মলদ্বারে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ব্যথার কারণ হতে পারে।
৭. প্রোলাপ্সড রেকটাম
প্রোলাপ্সড রেকটাম হল এমন একটি অবস্থা যেখানে মলদ্বারের কিছু অংশ বাইরে বেরিয়ে আসে। এটি খুবই ব্যথাদায়ক হতে পারে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন।
৮. গর্ভাবস্থার কারণে মলদ্বারের চাপ
গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে মলদ্বারের উপরে শিশুর চাপ পড়লে মলদ্বারে ব্যথা হতে পারে। এটি স্বাভাবিক হলেও অস্বস্তিকর হতে পারে।
৯. যৌন সংক্রমণ
কিছু যৌনবাহিত রোগ যেমন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV), হर्पিস, বা গনোরিয়া মলদ্বারে সংক্রমণ ঘটিয়ে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।
১০. ক্যান্সার
মলদ্বারে বা পায়ুপথে ক্যান্সার হলে মলদ্বারের আশেপাশে ক্রমাগত ব্যথা হতে পারে। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়।
মলদ্বারে ব্যথার উপসর্গ
মলদ্বারে ব্যথার সাথে আরও কিছু উপসর্গ থাকতে পারে, যেমন:
- মলত্যাগের সময় বা পরে ব্যথা অনুভব করা।
- মলদ্বার থেকে পুঁজ বা রক্তপাত।
- মলদ্বারের আশেপাশে ফোলাভাব বা জ্বালাপোড়া।
- দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা এবং অস্বস্তি।
- জ্বর (বিশেষ করে ফিস্টুলা বা অ্যাবসেসের ক্ষেত্রে)।
মলদ্বারে ব্যথার চিকিৎসা ও প্রতিকার
১. পাইলসের চিকিৎসা
- বাড়িতে যত্ন: নিয়মিত কুসুম গরম পানিতে বসে থাকা (সিটজ বাথ)।
- ওষুধ: পাইলসের জন্য স্থানীয় ক্রিম ও ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। তীব্র পাইলসের ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
২. ফিসার চিকিৎসা
- চিকিৎসা: মল নরম রাখার জন্য ল্যাক্সেটিভ (মল নরম করার ওষুধ) এবং স্থানীয় ক্রিম প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- শল্যচিকিৎসা: যদি ফিসার দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে শল্যচিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
৩. ফিস্টুলার চিকিৎসা
- অ্যান্টিবায়োটিক: সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হতে পারে।
- শল্যচিকিৎসা: ফিস্টুলা প্রায়ই শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে মেরামত করতে হয়।
৪. সংক্রমণের প্রতিকার
- অ্যান্টিফাঙ্গাল বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ: ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
৫. এনাল অ্যাবসেসের চিকিৎসা
- ড্রেনেজ: অ্যাবসেসের পুঁজ ড্রেন করার জন্য শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
৬. প্রদাহজনিত রোগের চিকিৎসা
- IBD-এর চিকিৎসা: প্রদাহজনিত অন্ত্রের রোগের জন্য স্টেরয়েড ও অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
৭. ব্যথা নিয়ন্ত্রণে সাধারণ টিপস
- কুসুম গরম পানিতে সিটজ বাথ।
- প্রচুর পানি পান করা ও আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া মল নরম রাখতে সাহায্য করে।
- জোরে মলত্যাগ এড়ানো: কোষ্ঠকাঠিন্য এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও ল্যাক্সেটিভ ব্যবহার করা।
উপসংহার
মলদ্বারে ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এর পেছনের কারণগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনুসারে চিকিৎসা নিলে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। মলদ্বারে যদি দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা থাকে বা ব্যথার সাথে রক্তপাত, পুঁজ, বা অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়, তবে দ্রুত একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।