ডায়রিয়া একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা যা যে কোনো বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের জন্য এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ ডায়রিয়া শরীরে দ্রুত পানিশূন্যতা তৈরি করে। ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে দ্রুত সঠিক ব্যবস্থা না নিলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই ডায়রিয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা জরুরি। এই ব্লগে ডায়রিয়ার কারণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ডায়রিয়ার কারণ:
ডায়রিয়ার মূল কারণ হলো দূষিত খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণ। এছাড়া আরও কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো ডায়রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
১. ভাইরাস সংক্রমণ:
নোরোভাইরাস এবং রোটাভাইরাসের মতো ভাইরাসের সংক্রমণে ডায়রিয়া হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে রোটাভাইরাস সংক্রমণ ডায়রিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
২. ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ:
দূষিত খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমে সালমোনেলা, ই-কোলাই, শিগেলা প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে ডায়রিয়া হতে পারে। সাধারণত এই ধরনের সংক্রমণ খাদ্য বিষক্রিয়া ঘটায়।
৩. পরজীবী সংক্রমণ:
পানিতে থাকা বিভিন্ন পরজীবী যেমন—জিয়ার্ডিয়া, ক্রিপ্টোসপোরিডিয়াম ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে। দূষিত পানি পান করলে এসব পরজীবী শরীরে প্রবেশ করে।
৪. অতিরিক্ত মসলাযুক্ত বা তৈলাক্ত খাবার:
অনেক সময় অতিরিক্ত মসলাযুক্ত, ভাজাপোড়া, বা তৈলাক্ত খাবার খেলে হজমের সমস্যা হয়, যা ডায়রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
৫. এলার্জি বা খাবারের অ্যালার্জি:
কিছু মানুষের শরীরে কিছু নির্দিষ্ট খাবারের প্রতি অ্যালার্জি থাকে, যা ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে। যেমন দুধ বা দুধের প্রোটিন ল্যাকটোজে অ্যালার্জি থাকলে ডায়রিয়া হতে পারে।
৬. অ্যান্টিবায়োটিক সেবন:
কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ হজম প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে, যা ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকেও ধ্বংস করতে পারে।
ডায়রিয়ার লক্ষণ:
- ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হওয়া
- পেটের ব্যথা বা ক্র্যাম্প
- বমি বমি ভাব বা বমি
- শরীরের পানিশূন্যতা
- জ্বর (কিছু ক্ষেত্রে)
- তলপেটে অস্বস্তি
ডায়রিয়ার প্রতিকার:
ডায়রিয়া হলে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত যাতে শরীরের পানিশূন্যতা রোধ করা যায় এবং দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়।
১. ওআরএস (ORS) সেবন:
ডায়রিয়া হলে শরীরে দ্রুত পানি ও লবণের ঘাটতি দেখা দেয়। এই ঘাটতি পূরণের জন্য ওআরএস (ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন) পান করা অত্যন্ত জরুরি। ওআরএস শরীরের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে।
২. পানি এবং তরল পানীয় বেশি পান করুন:
ডায়রিয়ার সময় শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে যায়, তাই বেশি পরিমাণে পানি পান করা প্রয়োজন। এছাড়াও, ডাবের পানি, লেবুর শরবত, সুপ, এবং স্যুপ পান করুন।
৩. হালকা খাবার খান:
ডায়রিয়ার সময় হজমের সমস্যা হয়, তাই সহজে হজম হয় এমন হালকা খাবার যেমন—ভাত, সেদ্ধ ডাল, সেদ্ধ আলু, কলা, টোস্ট, ইত্যাদি খান। অতিরিক্ত মসলাযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন।
4. প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট বা দই খান:
প্রোবায়োটিক শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই ডায়রিয়ার সময় প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট অথবা দই খাওয়া উপকারী হতে পারে।
৫. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন:
ডায়রিয়া হলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। বিশ্রাম শরীরকে দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে।
৬. ঔষধ সেবন:
কিছু ক্ষেত্রে ডায়রিয়া হলে ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ সেবন করতে হয়। তবে, কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা ডায়রিয়ার ঔষধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করবেন না।
ডায়রিয়া প্রতিরোধে করণীয়:
১. পরিষ্কার ও নিরাপদ খাবার ও পানীয় গ্রহণ:
ডায়রিয়া প্রতিরোধের প্রথম শর্ত হলো পরিষ্কার ও নিরাপদ খাদ্যাভ্যাস। খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের আগে তা পরিষ্কার ও নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করুন। রাস্তার খাবার বা অনিরাপদ পানীয় এড়িয়ে চলুন।
২. হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন:
ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে খাওয়ার আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন। নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস আপনাকে ডায়রিয়া সহ অন্যান্য সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে।
৩. ফলমূল ও শাকসবজি ভালোভাবে ধুয়ে নিন:
ফলমূল ও শাকসবজি ভালোভাবে ধুয়ে তারপর খাওয়ার অভ্যাস করুন। বিশেষ করে যেগুলো কাঁচা খাওয়া হয়, সেগুলো সাবধানে ধুয়ে নিন।
৪. নিরাপদ পানি পান করুন:
দূষিত পানির কারণে ডায়রিয়া হতে পারে, তাই পানির উৎস নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করুন। বাসার পানির জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন, যেমন—ফিল্টার, ফুটিয়ে পানি পান করা ইত্যাদি।
৫. ভ্যাকসিন গ্রহণ করুন:
ডায়রিয়ার জন্য কিছু ভাইরাস যেমন—রোটাভাইরাসের জন্য ভ্যাকসিন রয়েছে। রোটাভাইরাসের কারণে শিশুদের ডায়রিয়া হতে পারে, তাই শিশুদের জন্য এই ভ্যাকসিন নিতে পারেন।
ডায়রিয়া কখন বিপজ্জনক:
যদি ডায়রিয়া তিন দিনের বেশি স্থায়ী হয়, খুব বেশি পানি বেরিয়ে গেলে, বা পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, রক্তমিশ্রিত পায়খানা বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া দ্রুত বিপজ্জনক হতে পারে, তাই এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা করবেন না।
ডায়রিয়া একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এর সঠিক চিকিৎসা না নিলে তা গুরুতর হতে পারে। তাই ডায়রিয়া হলে দ্রুত ওআরএস পান করুন, বেশি তরল গ্রহণ করুন এবং হালকা খাবার খান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা এবং নিরাপদ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে ডায়রিয়া থেকে দ্রুত সেরে ওঠা সম্ভব