ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাসজনিত জ্বর যা এডিস মশার মাধ্যমে সংক্রামিত হয়। এটি বিশেষত গ্রীষ্মকালীন ও বর্ষাকালে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ডেঙ্গুর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে, তাই এর কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
এই ব্লগে ডেঙ্গু জ্বরের কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকারের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো।
১. ডেঙ্গুর কারণ
ডেঙ্গু ভাইরাসটি এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস নামক মশার মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। এই মশাগুলো দিনে, বিশেষত সকাল এবং সন্ধ্যার দিকে, বেশি সক্রিয় থাকে। যখন মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন সেই ভাইরাস মশার দেহে প্রবেশ করে এবং পরবর্তীতে তা অন্য ব্যক্তিকে কামড়ানোর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
২. ডেঙ্গুর লক্ষণসমূহ
ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের ৪-১০ দিন পর শুরু হয় এবং কয়েকদিন থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। লক্ষণগুলো সাধারণত নিম্নরূপ:
২.১. তীব্র জ্বর
ডেঙ্গুর প্রথম এবং প্রধান লক্ষণ হলো হঠাৎ তীব্র জ্বর, যা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তারও বেশি হতে পারে।
২.২. মাথাব্যথা
ডেঙ্গুর আরেকটি সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে তীব্র মাথাব্যথা। বিশেষত কপালের দিকে ব্যথা বেশি অনুভূত হয়।
২.৩. চোখের পেছনে ব্যথা
চোখের পেছনে ব্যথা ডেঙ্গুর একটি সাধারণ লক্ষণ। এই ব্যথা বেশ অস্বস্তিকর হতে পারে।
২.৪. শরীরে ও পেশীতে ব্যথা
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে শরীরে বিশেষত পেশীতে এবং হাড়ে তীব্র ব্যথা হয়। এই কারণে ডেঙ্গুকে “ব্রেকবোন ফিভার” নামেও ডাকা হয়।
২.৫. বমি বমি ভাব ও বমি করা
অনেক ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে বমি বমি ভাব এবং বমি করার প্রবণতা দেখা যায়।
২.৬. ত্বকে লালচে দাগ
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে ত্বকে লালচে ফুসকুড়ি বা দাগ দেখা দিতে পারে। এটি সাধারণত জ্বর শুরু হওয়ার ২-৫ দিনের মধ্যে দেখা যায়।
২.৭. রক্তপাত
গুরুতর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে নাক, মুখ বা মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে। এটি ডেঙ্গুর একটি গুরুতর লক্ষণ এবং সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
৩. ডেঙ্গুর প্রতিকার
ডেঙ্গুর জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। তবে উপসর্গ উপশমের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিচে কিছু প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ উল্লেখ করা হলো:
৩.১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
৩.২. পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ
শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা ডেঙ্গু জ্বরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রচুর পরিমাণ পানি, ফলের রস, স্যালাইন ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে। এতে শরীরের পানির অভাব পূরণ হয় এবং ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
৩.৩. প্যারাসিটামল সেবন
জ্বর ও ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল (Paracetamol) ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। তবে ডেঙ্গুতে এসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন ব্যবহার না করাই ভালো, কারণ এগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়।
৩.৪. রক্তের প্লাটিলেট পর্যবেক্ষণ
গুরুতর ডেঙ্গুতে রক্তের প্লাটিলেট সংখ্যা কমে যেতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষা করে প্লাটিলেটের স্তর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
৩.৫. মশার কামড় থেকে রক্ষা
ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। মশারোধী ক্রিম ব্যবহার, মশারি টাঙানো, এবং দিনের বেলা মশা প্রতিরোধক পোশাক পরা মশার কামড় থেকে রক্ষা করতে সহায়ক।
৪. ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা এবং মশার বিস্তার রোধ করা জরুরি। নিচে কিছু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ উল্লেখ করা হলো:
৪.১. জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলা
এডিস মশা সাধারণত জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে বংশবিস্তার করে। তাই ঘরের আশেপাশে জমে থাকা পানি অপসারণ করা উচিত, যেমন ফুলের টব, টায়ার, ড্রাম ইত্যাদি।
৪.২. মশারি বা মশারোধী নেট ব্যবহার
রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া দরজা ও জানালায় মশারোধী নেট লাগানো উচিত।
৪.৩. মশারোধী ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার
দিনের বেলায় বাইরে বের হলে মশারোধী ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করতে হবে, যাতে মশা কামড়াতে না পারে।
ডেঙ্গু একটি গুরুতর ভাইরাসজনিত রোগ, যা সঠিক সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত এবং দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সচেতন থাকুন, মশার বিস্তার রোধ করুন, এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে আপনার ভূমিকা রাখুন।