জরায়ুমুখ ক্যান্সার (Cervical Cancer) নারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি ক্যান্সার, যা জরায়ুর মুখে (সার্ভিক্স) অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন ও বৃদ্ধি থেকে শুরু হয়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিলে এই ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নিরাময়যোগ্য হতে পারে। তবে সচেতনতা, প্রাথমিক স্তরে সনাক্তকরণ, এবং উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ ও নিরাময় সম্ভব।
জরায়ুমুখ ক্যান্সার কতটা নিরাময়যোগ্য?
জরায়ুমুখ ক্যান্সার নিরাময়ের সম্ভাবনা নির্ভর করে ক্যান্সারটি কতটা আগ্রাসী এবং এটি কোন পর্যায়ে সনাক্ত হয়েছে। যদি ক্যান্সারটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে, তাহলে এটি সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা সম্ভব। নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জরায়ুমুখ ক্যান্সারের নিরাময় সম্ভাবনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:
১. প্রাথমিক সনাক্তকরণ:
যদি ক্যান্সারটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে, যেমন স্টেজ ১ বা স্টেজ ২ তে, তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে প্রায় ৮০% থেকে ৯০% পর্যন্ত নিরাময় সম্ভব। প্রাথমিক স্তরে ক্যান্সারটি শুধুমাত্র জরায়ুতে সীমাবদ্ধ থাকে, যা চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত সময়।
২. ক্যান্সারের ধরণ:
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের প্রধান দুই ধরনের মধ্যে অন্যতম হলো স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা এবং অ্যাডেনোকারসিনোমা। স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা বেশি সাধারণ এবং এর নিরাময় সম্ভাবনা সাধারণত বেশি। অ্যাডেনোকারসিনোমা তুলনামূলকভাবে বিরল এবং এটি কিছুটা বেশি আক্রমণাত্মক।
৩. চিকিৎসার ধরণ ও কার্যকারিতা:
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের চিকিৎসায় সাধারণত সার্জারি, কেমোথেরাপি, এবং রেডিওথেরাপি ব্যবহৃত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে সার্জারির মাধ্যমে ক্যান্সার আক্রান্ত টিস্যু অপসারণ করা যায়, যা প্রায়শই সম্পূর্ণ নিরাময় এনে দেয়। উন্নত পর্যায়ে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি মিলিতভাবে ব্যবহার করা হয়।
জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়:
১. HPV ভ্যাকসিন:
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) জরায়ুমুখ ক্যান্সারের প্রধান কারণ। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে বা ১১-১২ বছর বয়স থেকে এই ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করা হয়, যা ভবিষ্যতে ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
২. নিয়মিত স্ক্রিনিং:
জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার জন্য নিয়মিত প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট (Pap Smear) এবং HPV টেস্ট করা উচিত। এই স্ক্রিনিং টেস্টগুলি জরায়ুর কোষের অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করতে সহায়ক, যা ক্যান্সারের পূর্বাভাস দিতে পারে। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত হয়, তাহলে ক্যান্সার হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৩. সুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক:
যেহেতু HPV মূলত যৌন সংক্রমণের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই সুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক ও যৌন জীবনে সচেতনতা জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণ:
জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে খুব বেশি লক্ষণ প্রকাশ করে না। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- মাসিকের বাইরে অনিয়মিত রক্তপাত
- যৌনমিলনের পর রক্তপাত
- পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি
- প্রায়শই প্রস্রাব করার প্রবণতা
- ক্লান্তি বা দুর্বলতা
চিকিৎসা ও নিরাময় পদ্ধতি:
১. সার্জারি:
ক্যান্সার আক্রান্ত টিস্যু অপসারণের জন্য বিভিন্ন ধরণের সার্জারি ব্যবহার করা হয়। যেমন কনাইজেশন, হিসটেরেকটমি (জরায়ু অপসারণ), এবং প্যারামেট্রিকটমি।
২. কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি:
কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি মেটাস্ট্যাটিক বা উন্নত পর্যায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ধীর করে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করে।
৩. ইমিউনোথেরাপি:
ইমিউনোথেরাপি একটি উদ্ভাবনী চিকিৎসা পদ্ধতি, যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। এটি বর্তমানে কিছু রোগীর জন্য কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
উপসংহার:
জরায়ুমুখ ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য, বিশেষ করে যদি তা প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা যায়। তাই নিয়মিত স্ক্রিনিং, HPV ভ্যাকসিন গ্রহণ এবং সুরক্ষিত যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ সময়মতো সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে জরায়ুমুখ ক্যান্সার সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা সম্ভব।
ঠিকানা: পাইনেল মেন্টাল হেলথ কেয়ার সেন্টার, ২২২/১বি, সাউথ পীরেরবাগ, মিরপুর-২, ঢাকা -১২১৬।
ফোন: ০১৬৮১০০৬৭২৬.