সন্তান প্রসবের পর মায়ের জীবনে বড় ধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে নতুন মায়েরা নানা ধরনের মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হন, যা মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। সন্তান জন্মের পর মানসিক সমস্যা থেকে শুরু করে গুরুতর মানসিক অসুস্থতাও দেখা দিতে পারে, যা মায়ের পাশাপাশি শিশুর যত্নের ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করে। প্রসব-পরবর্তী মানসিক সমস্যা তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায়:
১. বেবি ব্লুজ (Baby Blues)
লক্ষণ:
বেবি ব্লুজ হলো সন্তান প্রসবের পর মায়ের মানসিক অবস্থার এক ধরনের অস্থায়ী পরিবর্তন, যা সাধারণত জন্মের ২-৩ দিনের মধ্যে শুরু হয় এবং ২ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটি তুলনামূলকভাবে সাধারণ এবং গুরুতর নয়। এ সময় মায়ের মধ্যে মনমরা ভাব, উদ্বেগ, এবং হালকা বিষণ্ণতা দেখা দেয়। এছাড়া, মায়েরা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে পারেন, যেমন হঠাৎ কাঁদা বা মন খারাপ হওয়া।
কারণ:
- প্রসবের পর হরমোনের দ্রুত পরিবর্তন
- ঘুমের ঘাটতি
- নতুন দায়িত্ব এবং শিশুর যত্ন নিয়ে উদ্বেগ
- শারীরিক ক্লান্তি
সমাধান:
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া
- পরিবারের সমর্থন নেওয়া
- শরীরের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া
২. প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতা (Postpartum Depression – PPD)
লক্ষণ:
প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতা একটি গুরুতর মানসিক সমস্যা, যা সন্তান জন্মের কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই শুরু হতে পারে এবং এটি বেবি ব্লুজের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী হয়। এ সমস্যার মধ্যে মায়েরা মারাত্মক বিষণ্ণতা, দুর্বলতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, এবং কখনও কখনও শিশুর প্রতি আগ্রহহীনতা অনুভব করতে পারেন। মায়েরা তাদের মধ্যে অবহেলিত বোধ করতে পারেন এবং অনেকে আত্মঘাতী চিন্তা করতে পারেন।
কারণ:
- হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ
- প্রসবের পর শারীরিক দুর্বলতা এবং ব্যথা
- পারিবারিক বা আর্থিক সমস্যা
সমাধান:
- একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা
- থেরাপি বা কাউন্সেলিং
- পরিবারের কাছ থেকে মানসিক সহায়তা এবং ভালবাসা পাওয়া
- প্রয়োজনে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ ব্যবহার
৩. প্রসব-পরবর্তী মনস্তাপ (Postpartum Psychosis)
লক্ষণ:
প্রসব-পরবর্তী মনস্তাপ একটি অত্যন্ত গুরুতর এবং বিরল মানসিক সমস্যা, যা সাধারণত প্রসবের পরপরই দেখা দেয়। এটি এক ধরনের মানসিক বিকৃতি, যেখানে মায়ের মধ্যে বিভ্রান্তি, হ্যালুসিনেশন (অবাস্তব জিনিস দেখা বা শোনা), অবাস্তব বিশ্বাস, এবং নিজের কিংবা শিশুর প্রতি সহিংস মনোভাব দেখা দিতে পারে। এই অবস্থা মারাত্মক বিপদজনক এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন।
কারণ:
- হরমোনের চরম পরিবর্তন
- পূর্বের মানসিক অসুস্থতা (যেমন বাইপোলার ডিসঅর্ডার)
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং শারীরিক দুর্বলতা
সমাধান:
- তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা নেওয়া
- হাসপাতালে ভর্তি করে মানসিক চিকিৎসা
- পরিবারের তত্ত্বাবধানে রাখা
- প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন এবং থেরাপি
সন্তান প্রসবের পর মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সতর্ক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো ধরনের মানসিক সমস্যার লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। পরিবারের সমর্থন এবং মায়ের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে পারে।