রাসেল ভাইপার (Russell’s Viper) একটি মারাত্মক বিষধর সাপ, যা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিপজ্জনক সাপ হিসেবে পরিচিত। রাসেল বাইপার সাপকে চন্দ্রবোড়া বা উলুবুরু সাপ নামেও ডাকা হয়। এর বিষের কারণে অনেক মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে বা মৃত্যুবরণ করে। রাসেল ভাইপার আতঙ্ক, স্নেক ফোবিয়া (Snake Phobia), এবং ওফিডিওফোবিয়া (Ophidiophobia) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং এই সাপে কামড়ালে করণীয় সম্পর্কে জানুন।
বিঃদ্রঃ আমরা জানি অনেকের ভিতরে স্নেক ফবিয়া থাকে যেটি একটি মানসিক রোগ। বর্তমানে রাসেল ভাইপার সাপ নিয়ে যে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে তাতে যেন স্নেক ফবিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিমাণ বেড়ে না যায় সেই উদ্দেশ্যে বর্তমান এই ক্রাইসিস সময়ে কি কি করনীয় তা আমার ব্লক পোস্ট এবং youtube ভিডিওর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস করেছি মাত্র।
বর্তমানে রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ ৬৪ টি জেলার ৩০ টিরও অধিক জেলাতে যেমনঃ খুলনা রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, টাঙ্গাইল, ভোলা, বরগুনা, নোয়াখালী সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, পিরোজপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, এমনকি ঢাকার কাছাকাছি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গিয়েছে।
1796 সালে স্কুটিস সার্জন ও পেট্রিক রাসেল তাদের বইতে রাসেল ভাইপার নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করেন। এইজন্য এই সাপের নাম রাসেল ভাইপার রাখা হয়েছে।
মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এদের প্রজননের সময়। এই সময় এই সাপের বাচ্চাদের এবং বড় সাপের আনাগোনা বেশি থাকে। মনে রাখবেন রাসেল ভাইপারের বড় সাপে যেমন বিষ থাকে ছোট সাপে ঠিক সেরকমই বিষ থাকে বরং ছোট সাপগুলো বেশি রাগী ও আক্রমণাত্মক হয়।
শ্রীলংকা ও ইন্ডিয়াতে সর্প দংশনে আক্রান্তের 30% থেকে 40% হয় এই রাসেল ভাইপারের কারণে।
নিচের ছবির মাধ্যমে রাসেল ভাইপার সাপ কিভাবে বাংলাদেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে দেখে নিতে পারেনঃ
রাসেল ভাইপার: একটি মারাত্মক সাপ
রাসেল ভাইপার একটি তেজী এবং আক্রমণাত্মক সাপ, যা মানুষ দেখলেই তেরে আসে। এই সাপটি অন্যান্য বিষাক্ত সাপের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি রাগী। এর দেহ মোটাসোটা, লেজ ছোট এবং সরু, এবং মাথা চ্যাপ্টা ত্রিকোণাকার। এটির বিষ অত্যন্ত শক্তিশালী, যা বিভিন্ন ধরনের টক্সিন ধারণ করে।
রাসেল ভাইপার কেন অন্যান্য সাপ থেকে বিষাক্ত ও ভয়ানক?
দেশে ১০৪ প্রজাতির সাপ রয়েছে যার 30 থেকে 40 ভাগ বিষধর।
বিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ বলে এন্টিভেনম দিলেও কেবলমাত্র ২০% মানুষ মৃত থেকে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এর বিষে হেমাটক্সিলিন থাকে যার কারণে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না।
পক্ষান্তরে অন্যান্য বিষধর সাপ যেমন গোখরা, কিউটে এর বিষ নিউরো টক্সিন থাকে যা সেন্টারাল নার্ভাস সিস্টেমে আক্রমণ করে তাই এদের বিষ নষ্ট করতে এনটিভিনামই যথেষ্ট।
রাসেল ভাইপার সাপের দংশন প্রকৃতি
এক সেকেন্ডের ১৬ ভাগের এক ভাগ সময় কামড়ে বিষ ঢালতে পারে। কামড় দিয়ে কুন্ডালী পাকিয়ে গাপটি দিয়ে থাকে। তাই এটি চন্দ্রবোড়া বা উলুবুরু নামেও পরিচিত।
রাসেল ভাইপার রেকর্ড সংখ্যক বাড়ছে কারন এরা একসাথে ৪০টি থেকে ৯০টি পর্যন্ত সরাসরি বাচ্চা দেয় এবং ইন্ডিয়া থেকে সরাসরি পানির মাধ্যমে চলে আসি।
রাসেল ভাইপার সাপের ছবি
আপনারদের চেনার সুবিধার্থে নিচে রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের কিছু ছবি দিচ্ছি। এই সাপ দেখতে অনেকটা অজগর সাপের মতো হলেও ভিন্ন কিছু পার্থক্য আছে যা ছবির মাধ্যমে দেখতে পারবেন।
রাসেল ভাইপার সাপের ভিডিওটি দেখুন
রাসেল ভাইপার সাপ বনাম অজগর
রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া এবং অজগর এর মধ্যে পার্থক্য জানা খুবই দরকার। অনেকে আছেন রাসেল ভাইপার সাপকে অজগর ভেবে কাছাকাছি যান যার কারণে এই সাপ দংশন করতে পারে এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ছবির পিকচারটি দেখুন এদের লেজ, মাথা এবং শরীরের দাগ গুলোতে ভিন্নতা রয়েছে।
রাসেল ভাইপার বিষের প্রভাব
রাসেল ভাইপার সাপে প্রায় পাঁচ ধরনের বিষ থাকে যা অনেক ক্ষেত্রে এনটিভেনম (Antivenom) দেওয়া হলেও কাজ করে না। এর বিষের কারণে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না, লোহিত রক্ত কণিকা নষ্ট হয়ে যায়, এবং রক্তনালি ফেটে গিয়ে চামড়ার নিচে রক্ত জমা হয়। এছাড়া, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া, এবং বমি হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
রাসেল ভাইপার কামড়ালে কী করবেন
1. প্রথমেই শান্ত থাকুন: সাপে কামড়ানোর পর আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার প্রস্তুতি নিন। বেশিরভাগ মানুষই সাপের কামড়ে মারা যান এর কারণ হচ্ছে তারা অনেক বেশি আতঙ্কগ্রস্থ হন এবং যার প্রেক্ষিতে তারা হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোক করেন। গোখরা সাপকে আমরা বিষধর হিসেবে জানি। এই সাপ অন্যান্য প্রাণীদের আক্রমনাত্মক হয়ে ভয় দেখায় কিন্তু তারা ছোবল দিলেও বিষ bite করে না। কারণ এদের বিষ এদের জন্য দরকারি। তাদের এই বিষের মাধ্যমে শিকারি খাবারকে ঘায়েল করে। কিন্তু মানুষ যখন দেখে তাকে কোন সাপ কামড় দিয়েছে তখনই সে প্রচুর মানসিক চাপ ও আতঙ্কগ্রস্ত হয় যার কারনে তার হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেন স্টক হয়। সুতরাং ভয়ে না পেয়ে কিংবা ওঝা, কবিরাজ এর কাছে গিয়ে সময় ক্ষেপণ না করে বরং যত দ্রুত সম্ভব আপার নিকটবর্তী হাসপাতালে যাওয়া বাধ্যতামূলক।
2. কামড়ানো জায়গা নড়াচড়া করবেন না: কামড়ানোর স্থানে নড়াচড়া বন্ধ করে স্থির অবস্থায় রাখুন, যাতে বিষ দ্রুত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
3. দ্রুত চিকিৎসা নিন: রাসেল ভাইপার কামড়ানোর পর ১০০ মিনিটের মধ্যে এনটিভেনম নেওয়া উচিত। অনেক ক্ষেত্রে ৭২ ঘন্টার মধ্যেও এনটিভেনম কাজ করতে পারে, তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা নেওয়াই উত্তম।
4. স্থানীয় হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করুন: রাসেল ভাইপার কামড়ানোর পর দ্রুত স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্র বা হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করুন এবং এনটিভেনম পাওয়ার ব্যবস্থা করুন।
5. দংশন স্থান পরিষ্কার রাখুন: দংশন স্থানে কোনো ধরনের মলম বা ওষুধ প্রয়োগ করবেন না। পরিষ্কার এবং শুকনো রাখার চেষ্টা করুন।
রাসেল ভাইপার থেকে বাঁচার উপায়
1. সাবধানতা অবলম্বন: ধান ক্ষেতে কাজ করার সময় সতর্ক থাকুন। সাপের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
2. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: সাপের বসবাসযোগ্য স্থান যেমন ঘাসজমি, পাথরের নিচ, বা গাছের গোড়া থেকে দূরে থাকুন।
3. কৃষকদের সচেতনতা: ধান ক্ষেতে কাজ করার সময় জুতো পরা এবং লাঠি নিয়ে হাঁটা।
রাসেল ভাইপার ও স্নেক ফোবিয়া
স্নেক ফোবিয়া এবং ওফিডিওফোবিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের আতঙ্ক দূর করতে এবং সাপের কামড় থেকে বাঁচতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
রাসেল ভাইপার সাপের চিকিৎসা ও গবেষণা
ঘোড়া, মুরগি, এবং উটের রক্ত থেকে এন্টিবডি নিয়ে এনটিভেনম তৈরি করা হয়, যা রাসেল ভাইপার কামড়ানোর পর প্রয়োগ করা হয়। তবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা, যা দুই বছর পর্যন্ত চলতে পারে।
নিচে ইউটিউবে রাসেল ভাইপার এর উপর আমার একটি ভিডিও করা আছে। আশা করি আপনি যদি বাংলাদেশের যে কোন জায়গাতে থাকেন এই ভিডিওটি দেখে আপনি রাসেল ভাইপার সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য যেমনঃ রাসেল ভাইপার বাঁ চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের বিষক্রিয়া, রাসেল ভাইপার সাপের চিকিৎসা, রাসেল ভাইপার কি, রাসেল ভাইপারের এন্টিভেনম, রাসেল ভাইপারের বাচ্চা, ইত্যাদি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবেন।
বিঃদ্রঃ আমার এই চ্যানেলে মানুষের স্বাস্থ্য সম্বলিত বিভিন্ন রকমের শিক্ষনীয় এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে থাকি। আপনি যদি ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন আপডেটেড তথ্য পেতে চান কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কোন পরামর্শ চান তাহলে চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখতে পারেন। আপনার জন্য শুভকামনা।
উপসংহার
রাসেল ভাইপার আতঙ্ক এবং এর কামড়ানোর পর করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সাপের কামড় থেকে বাঁচতে এবং সঠিক চিকিৎসা নেওয়ার মাধ্যমে জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। রাসেল ভাইপার সম্পর্কে আরও জানুন এবং সাবধান থাকুন।
আর্টিকেলটি লিখেছেন আসাদুজ্জামান রাজু আকন, সাইকোলজিস্ট ও MPhil research fellow, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।