বন্ধ্যাত্ব কি?
বন্ধ্যাত্ব হল একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে একজন নারী বা পুরুষ স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। সাধারাণত, ১২ মাস ধরে নিয়মিত অসুরক্ষিত যৌনমিলন সত্ত্বেও গর্ভধারণ করতে না পারলে সেটিকে বন্ধ্যাত্ব বলা হয়। এটি মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষদের ক্ষেত্রেও হতে পারে।
বন্ধ্যাত্বের ধরন
বন্ধ্যাত্ব প্রধানত দুটি ধরনের হতে পারে:
- প্রাথমিক বন্ধ্যাত্ব: একজন নারী কখনোই গর্ভধারণ করতে সক্ষম হননি।
- দ্বিতীয়িক বন্ধ্যাত্ব: একজন নারী পূর্বে গর্ভধারণ করতে সক্ষম ছিলেন, কিন্তু পরে গর্ভধারণে ব্যর্থ হন।
বন্ধ্যাত্বের কারণ
নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই বন্ধ্যাত্বের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কিছু সাধারণ কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
নারীদের বন্ধ্যাত্বের কারণ
- ডিম্বাণু তৈরি বা মুক্তির সমস্যা (Ovulation Disorder): অনিয়মিত বা অনুপস্থিত মাসিক চক্রের কারণে ডিম্বাণু তৈরি বা মুক্তি হতে পারে না। পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS), থাইরয়েডের সমস্যা, প্রোল্যাক্টিন হরমোনের অতিরিক্ত পরিমাণ ইত্যাদি এ সমস্যার জন্য দায়ী।
- ফ্যালোপিয়ান টিউবের বাধা (Blocked Fallopian Tubes): ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লক হয়ে গেলে ডিম্বাণু শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না। পিভিআইডি (Pelvic Inflammatory Disease), এন্ডোমেট্রিওসিস ইত্যাদি কারণে ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লক হতে পারে।
- ইউটেরাইন সমস্যা (Uterine Problems): ইউটেরাসে গঠিত ফাইব্রয়েড বা পলিপ, অথবা ইউটেরাইন আকারের সমস্যা বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে।
পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের কারণ
- শুক্রাণুর গুণগত মান কম হওয়া: শুক্রাণুর সংখ্যা কম হলে বা অস্বাভাবিক আকারের শুক্রাণু থাকলে সন্তান ধারণের ক্ষমতা হ্রাস পায়।
- শুক্রাণুর গতিশীলতা (Motility) কম হওয়া: শুক্রাণুর অস্বাভাবিক গতি বা চলাচলের অভাবে শুক্রাণু ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হতে ব্যর্থ হয়।
- শুক্রাণু ব্লকেজ (Blockage in sperm ducts): শুক্রাণু নির্গমনের পথ ব্লক থাকলে তা শুক্রাণুর মুক্তির পথে বাধা সৃষ্টি করে।
বন্ধ্যাত্বের লক্ষণ
নারী এবং পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই বন্ধ্যাত্বের প্রধান লক্ষণ হল গর্ভধারণ করতে না পারা। তবে কিছু অন্যান্য লক্ষণও দেখা দিতে পারে:
- নারীদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত বা অনুপস্থিত মাসিক চক্র।
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত ব্যথা।
- যৌনমিলনের সময় ব্যথা অনুভব।
- পুরুষদের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর মানহীনতা বা অল্প পরিমাণ শুক্রাণু।
বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা
বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা মূলত বন্ধ্যাত্বের কারণ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এখানে কিছু সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:
১. ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা:
অনেক ক্ষেত্রে ডিম্বাণু মুক্তির জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। ক্লোমিফেন সাইট্রেট (Clomiphene citrate) এবং লেট্রোজোল (Letrozole) হল ডিম্বাণু তৈরিতে সাহায্যকারী কিছু সাধারণ ওষুধ।
২. ইনট্রা ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন (IUI):
এই পদ্ধতিতে পুরুষের শুক্রাণু সংগ্রহ করে সেটিকে নারীর ইউটেরাসে প্রয়োগ করা হয়। শুক্রাণু ফ্যালোপিয়ান টিউবের মাধ্যমে ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হয় এবং গর্ভধারণ ঘটে।
৩. ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF):
আইভিএফ পদ্ধতিতে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু শরীরের বাইরে একটি ল্যাবরেটরিতে মিলিত করা হয় এবং নিষিক্ত ডিম্বাণুটি ইউটেরাসে প্রয়োগ করা হয়।
৪. সার্জারি:
যদি ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লক থাকে বা ইউটেরাসে ফাইব্রয়েড থাকে, তবে সার্জারি করে তা অপসারণ করা হয়। এন্ডোমেট্রিওসিসের জন্যও সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।
৫. হরমোনাল থেরাপি:
হরমোনাল ভারসাম্যহীনতার কারণে ডিম্বাণু মুক্তি বা শুক্রাণুর গুণগত মান কমে গেলে হরমোনাল থেরাপি দেওয়া হয়।
৬. লাইফস্টাইল পরিবর্তন:
ওজন নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়াম করে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি কমানো যায়। ধূমপান, মদ্যপান এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে বিরত থাকা জরুরি।
বন্ধ্যাত্ব প্রতিরোধের উপায়
বন্ধ্যাত্ব পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চললে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি কমানো সম্ভব:
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম।
- ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকা।
- সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকা।
উপসংহার
বন্ধ্যাত্ব নারী এবং পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে এবং এটি একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি অনেক সুযোগ তৈরি করেছে। তবে জীবনের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুললে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।