আপনি কি কাউন্সেলিং সাইকোলজিতে দক্ষ? 

আমার এই পোস্টটি মূলত যারা সাইকোলজি ফিল্ডে কাউন্সিলিং এ প্রফেশনালি কাজ করতে চাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে। আশা করবো মন দিয়ে লেখাটি পড়বেন। আপনারা চাইলে যেকোন রকমের আলোচনা সমালোচনা আমার এই পোস্টের ভিত্তিতে করতেই পারেন আমি খুশিই হব। আপনারা চাইলে কমেন্টে কিংবা ইনবক্সে ও আপনাদের আলোচনা সমালোচনা জানাতে পারবেন। 

আমাদের এই লেখাটিতে আমার একটি অবজারভেশন শেয়ার করতে চাচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটা ভাইভাতে আমি ছিলাম। 

আমি আসাদুজ্জামান রাজু ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট এবং এমফিল রিসার্চ ফেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনেকে আমাকে কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট রাজু আকন নামেও চিনেন। 

আমি একজন কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট। 

আমরা জানি মানসিক সমস্যায় দুই ধরনের চিকিৎসকরা বিশ্বব্যাপী প্রফেশনালি চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। 

১. সাইক্রিয়াটিস্ট ও 

২. প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট  

প্রথমেই আসেন আপনাদের একটু মোটিভেশন দেয়ার চেষ্টা করিঃ

মানসিক সমস্যার বিভিন্ন কারণ হতে পারে যেমনঃ জেনেটিকাল, বায়োলজিক্যাল, সোশ্যাল সাইকোলজিকাল, ড্রাগ এন্ড অ্যাডিকশন ইত্যাদি। 

বায়োলজিক্যাল মূলত ব্রেনের নিউরো ট্রান্সমিটারের অসামঞ্জসতা। যেমনঃ ডোপামিন, সেরেটোনিন, অ্যাড্রিনালিন, ননএপিনিফ্রিন ইত্যাদি।  

সাইক্রিয়াটিস্টরা মূলত বায়োলজিক্যাল বিষয়ে অনেক দক্ষ যেখানে একজন প্রফেশনাল সাইকোলজিস্টের কাজ কম থাকে। 

কাউন্সিলিং একটি মেডিকেল কিংবা ক্লিনিকাল টার্ম। এখানে সাজেশন, উপদেশ, পরামর্শ ইত্যাদির কোন ঠাঁই নাই। 

আমরা কাউন্সিলিং এ কিন্তু এই যে নিউরো ট্রান্সমিটারের অসামঞ্জস্য তাকে সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করি কিভাবে তো আমরা জানি তাই না..! যেমনঃ সিবিটি, টিএ ইত্যাদি থেরাপির মাধ্যমে।  

যেহেতু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সেই রকমের দক্ষ ক্লিনিকাল, কাউন্সিলিং বা অন্য সাইকোলজিস্ট তেমন তৈরি হয়নি সেই সুযোগে অনেক সাইক্রিয়াটিস্ট কাউন্সিলিং সেবাটি বড় একটা প্রেমেন্টে দিয়ে থাকেন। 

👉 গোপন কথা বলে দেব এখন- বেশিরভাগ সাইক্রিয়াটিস্ট সিবিটির কিছু টেকনিক ক্লায়েন্টকে সেশনে বলেন (যেমন ইআরপি, অল্টারনেটিভ থট কগনিটিভ রিস্ট্রাকচারিং, আরে বাদ দেন না আর কত..! এমন কিছু সাজেশন ইত্যাদি) আর পরিবেশগত কারণে বা পরিবারের লোকজনের জন্য যদি ক্লায়েন্টের মানসিক সমস্যাটা বৃদ্ধি পায় বা তাদের কারণে এটি হয় তাহলে বকাঝকা করে রুম থেকে বের করেও দেন এমনও কারো কারো মুখে শুনেছি 😒। এরপর এই ধরনের সাইক্রিয়াটিস্টরা কিছু সাজেশন কিছু ইনস্ট্রাকশন কিছু এডভাইস দিয়ে ক্লাইন্টকে ছেড়ে দেন। ক্লাইন্টতো মনে করে পেয়েছি একজন কাছের মানুষ এতদিন আমি কাউকে বলতে পারিনি কিছু সে আমার হয়ে বলে দিয়েছে। সেই তো আমার গুরু এরপর কিছু হলেই এর কাছেই আসতে হবে। দেখেন সেও কিন্তু রেপো (rapport) তৈরি করে ফেলছে।🥴

এরপর মাসে মাসে, বছরে বছরে চলে এরকম গুরু শিষ্যের কাউন্সিলিং সেশন। ক্লায়েন্টের রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, কষ্ট চলতে থাকে যদি না বাই-চান্স কোন প্রফেশনাল কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট কিংবা ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্টের সন্ধান না পান। 

(আমি পার্সোনালি খুবই হার্ট হই এই ধরনের ননপ্রফেশনাল অ্যাক্টিভিটির জন্য। আমি খুবই দুঃখিত এ কথাগুলো শেয়ার করতে হচ্ছে)  

এখন আসেন মূল কথায়ঃ

সাম্প্রতিক সময়ে দু একটি ভাইভার কমিটিতে আমি ছিলাম যেখানে  বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই ভাইভা দিয়েছে। 

এই রিক্রুটমেন্টের প্রধান লক্ষ্য ছিল “যারা প্রফেশনাল ডিগ্রি নিয়ে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এবং মানসিক সমস্যা নিয়ে যেকোনো ধরনের কাউন্সিলিং সেবা দিতে পারেন তাদেরকে নেয়া”

কাউন্সিলিং প্রফেশনের জন্য তিনটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ যেটা আমার অভিজ্ঞতায়ও আমি দেখেছি ও প্রমাণ পেয়েছে। 

১. কাউন্সিলিং চর্চা করা 

২. নিয়মিত কাউন্সিলিংয়ের এডভান্স বইগুলো পড়াশুনার মাধ্যমে আয়ত্ত করা  

৩. নিয়মিত সুপারবেশনে থাকা। 

যারা ভাইভা দিয়েছেন তাদের এই তিনটি বিষয়ে পর্যাপ্ত ঘাটতি আমার চোখে পড়ে সাথে সাথে আমার কাছে মনে হয়েছে যে কয়েকজন প্রফেশনাল ডিগ্রি নিয়েছে তাদের ভিতরে ধৈর্য কিছুটা কম। সাথে সাথে ভাইভা বোর্ডে এবং এর আগে এবং পরে যে ধরনের আচরণ কিংবা কার্যাবলী করতে হয় সে বিষয়ে অপারগতা আমি লক্ষ্য করেছি। 

১. কেউ আছেন কাউন্সিলিং এ মাস্টার্স পড়া শেষ কিন্তু কোন চর্চায় নেই। যার প্রেক্ষিতে তারা যে থিউরিটিক্যাল নলেজ গুলো জানতো সেগুলো ভুলে গিয়েছে। এমনকি তারা ঠিকমতো সেগুলোর নাম বলতে পারছে না। তাহলে তারা প্র্যাকটিসে কিভাবে এগুলো এপ্লাই করবে..! একজন ক্লায়েন্ট যখন আসে প্রথমেই তাকে রেপো (Rapport) তৈরি করার জন্য বিভিন্ন রকমের কাউন্সেলিং মাইক্রোস্কিল থাকে যেগুলো সেশনে এপ্লাই করতে না পারলে ওই ক্লায়েন্ট দ্বিতীয়বার কাউন্সিলর এর কাছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসে না। তারা বুঝতে পারে যে কাউন্সিলর তার অবস্থানটা অনুভব করতে পারছে না যেটিকে আমরা বলি এমপ্যাথি। যার জন্য ড্রপ আউট রেট বেড়ে যায় এবং তিনি কাউন্সিলিং এ আর আসেন না। সেই ক্লাইন্ট হয়তো এমনও হয় যে কাউন্সিলিং সম্পর্কে একটি নেগেটিভ ধারণা নিয়ে যায় তখন তারা সারা জীবন মানসিক রোগের কষ্টে ভুগতে থাকে।   

২. কাউন্সিলিং এ প্রফেশনাল ডিগ্রী নেয়া হলেও কাউন্সিলিংয়ের যে অ্যাডভান্স বইগুলো রয়েছে সেগুলো পড়া এবং সেগুলো নিয়মিত ক্লায়েন্ট ডিল করার সময় এপ্লাই করাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটা সেশন শেষে নিজেকে চেক করা। 

একজন ক্লায়েন্টের মাল্টিপল সিমটম নিয়ে আসতে পারে তখন এই অ্যাডভান্স বইয়ের লার্নিংগুলো অনেক সাহায্য করে। আবার মনে করেন আপনি যখন ভাইভাতে যাবেন তখন আপনাকে শুধুমাত্র মাস্টার্সে যা পড়েছেন এবং সেখান থেকে যতটুকু জ্ঞান আপনার ক্লায়েন্টের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন শুধু তাই নয় এছাড়াও এডভান্স লেভেলের বিষয়গুলো আপনাকে প্রশ্ন করবে। কেননা যখন ক্লাইন্ট ডিল করা হয় কিছু কিছু ক্লাইন্ট থাকে যারা সুপার ফেসিয়াল-মানে হল অনার্স মাস্টার্সের যে ইচ্ছা আমরা অর্জন করি তা ক্লাইন্টরা জানে তখন মনে করেন আপনার ওই গেস্টাল সাইকোলজি অ্যাপরোজ, এক্সিসটেন্সিয়াল সাইকোলজি অ্যাপরোজ, ই এম ডি আর, এন এল পি, এমইএসটি, ডায়ল্যাক্টিক বিহেবিয়ার থেরাপ, সেক্সুয়াল থেরাপি, ব্রিফ সাইকোথেরাপি, রিয়ালিটি সাইকোথেরাপি ইত্যাদি ব্যবহার করা লাগতে পারে। এগুলো সব কি আপনাদের মাস্টার্সে পড়ানো হয়..! 

৩. ভাইভাতে কেউ কেউ বলেছিল তারা মাস্টার্সে ৭-৮টি সুপারভিশন নিয়েছে। আমি মনে করি না একটি মাস্টার্স এর ক্ষেত্রে এই পরিমাণটা এপ্রোপ্রিয়েট। কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০টি সুপারভিশন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ (এটা আমার হিসাব)। নিয়মিত সুপারবেশনের গুরুত্ব অনেক বেশি। 

যে সকল টিচাররা শুধু টিচিং প্রফেশনে নন কাউন্সিলিংও করেন তাদেরকে আমি দক্ষই হিসেবে স্বীকৃতি দেব তবে সেও যদি সুপারভিশন এ থেকে কাউন্সিলিং করান সেটি যথাযথ। 

অনেকে বলেন তারা সুপারভিশন নেন তবে যাদের কাছ থেকে নেন তারা আসলে সেই রকম কাউন্সিলিং ফিল্ডে একাডেম দক্ষতা নেই। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই কোন প্রফেশনাল কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট যার প্রফেশনাল ফিল্ডে এমফিল কিংবা পিএইচডি ডিগ্রি আছে তার কাছ থেকে নেয়া ভালো। 

সর্বশেষে ধৈর্যের কথাটাই বলবো- প্রফেশনাল কাউন্সিলিং কিংবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হতে গেলে আপনাকে অবশ্যই ধৈর্য থাকতে হবে। যাদের ধৈর্য নেই বা কম তাদের ব্যক্তিগত স্ট্রেস কিংবা মানসিক চাপ কমানোর জন্য পার্সোনাল কাউন্সিলিং নেয়া দরকার হবে। সাথে সাথে সেলফ-হেল্প টেকনিক হিসেবে বিভিন্ন রকমের কৌশল যেমনঃ মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, বর্তমানে থাকার অনুশীলন, সাপোর্টটিভ গ্রুপ হেল্প এবং শারীরিক ব্যায়াম ইত্যাদির চর্চা করা যেতে পারে। 

কি আর বলবো অনেক কিছুই বলার ছিল..!😒 হয়তো ভবিষ্যতে আরো কিছু কথা বলব। 

অন্যের সাইকোলজিকাল কেয়ার নিশ্চিত করার জন্য প্রথমে আমি আমার সাইকোলজিকাল কেয়ার যথাযথভাবে নিব। সবার জন্য শুভকামনা।

**মানসিক স্বাস্থ্যের যে কোন বিষয়ে নির্দ্বিধায়  আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top