সাদা স্রাব বা লিউকোরিয়া মহিলাদের মধ্যে একটি সাধারণ শারীরিক ঘটনা। এটি মূলত যৌনাঙ্গ থেকে বের হওয়া একটি প্রাকৃতিক স্রাব, যা নারীদের শরীরের হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে ঘটে। সাধারণত সাদা স্রাব শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ, তবে অতিরিক্ত সাদা স্রাব হলে তা কোনো শারীরিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। এর জন্য সময়মতো প্রতিকার নেওয়া জরুরি।
অতিরিক্ত সাদা স্রাবের কারণ
১. হরমোনাল পরিবর্তন
নারীদের মাসিক চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে, যা সাদা স্রাবের পরিমাণ বাড়াতে পারে। বিশেষ করে মাসিক শুরুর আগে বা গর্ভাবস্থায় হরমোনাল পরিবর্তনের ফলে সাদা স্রাবের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।
২. ইনফেকশন বা সংক্রমণ
যোনিতে ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাল ইনফেকশনের কারণে অতিরিক্ত সাদা স্রাব হতে পারে। বিশেষ করে, ক্যান্ডিডা নামক এক ধরনের ফাঙ্গাসের সংক্রমণ সাদা স্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এতে স্রাবের সঙ্গে দুর্গন্ধ এবং চুলকানি হতে পারে।
৩. জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের প্রভাব
জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহারের ফলে অনেক মহিলার মধ্যে হরমোনাল ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়। এতে সাদা স্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৪. পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (PID)
পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ বা PID হলো যৌনাঙ্গের একটি গুরুতর ইনফেকশন, যা জরায়ু, ডিম্বাশয় এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবকে আক্রান্ত করে। এতে সাদা স্রাবের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে এবং পেটের নিচের অংশে ব্যথা, জ্বর বা ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
৫. সেক্সুয়াল ট্রান্সমিটেড ইনফেকশন (STI)
যৌন সংক্রমণ বা STI-এর কারণে অতিরিক্ত সাদা স্রাব হতে পারে। বিশেষ করে ক্ল্যামিডিয়া, গনোরিয়া ইত্যাদি সংক্রমণ স্রাবের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। এই সংক্রমণের কারণে যৌনাঙ্গে চুলকানি, ব্যথা বা জ্বালাপোড়া দেখা দিতে পারে।
৬. অপর্যাপ্ত ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা
ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখলে যোনির স্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়া ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, যা সাদা স্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত স্রাবের সঙ্গে দুর্গন্ধও হতে পারে।
অতিরিক্ত সাদা স্রাবের প্রতিকার
১. পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
যোনির চারপাশে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন পরিষ্কার পানি দিয়ে যোনি পরিষ্কার করতে হবে এবং সব সময় শুকনো ও পরিষ্কার আন্ডারগার্মেন্টস পরা উচিত।
২. ইনফেকশনের চিকিৎসা করা
যদি সাদা স্রাবের সঙ্গে চুলকানি, জ্বালাপোড়া বা দুর্গন্ধ থাকে, তবে তা ইনফেকশনের লক্ষণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে চিকিৎসা করা উচিত।
৩. প্রাকৃতিক প্রতিকার
অনেক সময় দই বা দইয়ের ব্যাকটেরিয়া সাদা স্রাব নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। এটি যোনির ব্যাকটেরিয়াল ভারসাম্য বজায় রাখে এবং ইনফেকশন প্রতিরোধে কার্যকর।
৪. হালকা এবং শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে সক্ষম পোশাক পরা
সুতি বা কটনের পোশাক পরা উচিত, যা শরীরের সঙ্গে লেগে না থাকে এবং শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারে। টাইট ফিটিং পোশাক বা সিনথেটিক আন্ডারওয়্যার পরা উচিত নয়, কারণ এতে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে।
৫. ডায়েট এবং পর্যাপ্ত পানি পান
সঠিক পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান সাদা স্রাবের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক। খাদ্যাভ্যাসে বেশি ফলমূল, শাকসবজি এবং প্রোবায়োটিক খাবার রাখা উচিত।
৬. যোগব্যায়াম এবং মেডিটেশন
যোগব্যায়াম এবং মেডিটেশন শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক। এটি শরীরের হরমোনাল ভারসাম্য রক্ষা করে এবং অতিরিক্ত সাদা স্রাবের সমস্যা কমাতে সহায়ক।
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সময়
- যদি সাদা স্রাবের পরিমাণ খুব বেশি হয় এবং তাতে দুর্গন্ধ বা চুলকানি থাকে।
- যদি স্রাবের রঙ পরিবর্তিত হয় এবং রক্ত মিশ্রিত হয়।
- যদি যৌনাঙ্গে ব্যথা বা পেটের নিচের অংশে চাপ অনুভব হয়।
- যদি স্রাবের সঙ্গে অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
উপসংহার
অতিরিক্ত সাদা স্রাব হওয়া কিছুটা অস্বস্তিকর হলেও এটি সাধারণত প্রাকৃতিক শারীরিক প্রক্রিয়া। তবে যদি এটি অতিরিক্ত হয় এবং তাতে কোনও অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঠিক পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই সমস্যার সমাধানে সহায়ক হতে পারে।